মাধ্যমিক ইতিহাস প্রথম অধ্যায় ৪ নম্বরের প্রশ্ন ও উত্তর
মাধ্যমিক ইতিহাস প্রথম অধ্যায় ৮ নম্বরের প্রশ্ন ও উত্তর
দশম শ্রেণি ইতিহাস প্রথম অধ্যায় ৪ নম্বরের প্রশ্ন ও উত্তর
দশম শ্রেণি ইতিহাস প্রথম অধ্যায় ইতিহাসের ধারণা ৪ নম্বরের প্রশ্ন ও উত্তর
মাধ্যমিক / দশম শ্রেণি
ইতিহাস
প্রথম অধ্যায় : ইতিহাসের ধারণা
প্রতিটি প্রশ্নের মান : ৪/৫/৮
১) আধুনিক ইতিহাসচর্চার বৈশিষ্ট্য লেখাে।
উত্তর:- ভূমিকা : আধুনিক ইতিহাসচর্চা হল প্রচলিত ইতিহাসচর্চা থেকে উত্তরণ। রাজার যুদ্ধজয়, দেশশাসন, রাজস্ব আদায় ও সাংবিধানিক কাজকর্মের ইতিহাসই ছিল প্রচলিত ইতিহাসচর্চার মূল বিষয়।
আধুনিক ইতিহাসচর্চার বৈশিষ্ট্য : বিশ শতকের গােড়া থেকে এই ধরনের ইতিহাসচর্চায় সমাজ ও অর্থনীতির অন্য বিষয়গুলিও যুক্ত হতে শুরু করে এবং নতুন ধরনের ইতিহাসচর্চা শুরু হয়; যেমন -
১. আধুনিক ইতিহাসচর্চা : আধুনিক ইতিহাসচর্চার বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি হল—যুক্তিবাদী, আপেক্ষিকতাবাদী, দৃষ্টবাদী, মার্কসবাদী, প্রত্যক্ষবাদী দৃষ্টিভঙ্গি। এ ছাড়াও রয়েছে অ্যানাল গােষ্ঠীর মতবাদ, জাতীয়তাবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি, নিম্নবর্গীয় মতবাদ এবং সামগ্রিক সমাজ বিশ্লেষণমূলক দৃষ্টিভঙ্গি।
২. নীচুতলার ইতিহাস : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইংল্যান্ডের কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় ও মার্কসবাদী মতাদর্শে বিশ্বাসী ইউরােপের ঐতিহাসিকগণ (ক্রিস্টোফার হিল, এরিক হবসবম, প্যাট্রিক জয়েস, এডওয়ার্ড থম্পসন প্রমুখ।) সমাজের নীচুতলা থেকে ইতিহাস রচনায় সচেষ্ট হন।
৩. নতুন সামাজিক ইতিহাস : ১৯৬০ ও ১৯৭০-এর দশকে ইউরােপ ও আমেরিকায় ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি ও তাদের দৈনন্দিন জীবনযাপন, জাতি-বর্ণ ও জাতিবিদ্বেষ, হিংসা ও সম্প্রীতিসহ সমগ্র সমাজের ইতিহাস রচনার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয় যা নতুন সামাজিক ইতিহাস নামে পরিচিত।
এই ইতিহাসচর্চায় যুক্ত গবেষকরা হলেন—ইউজিন জেনােভিস, হারবার্ট গুটম্যান, রণজিৎ গুহ, জ্ঞানেন্দ্র পাণ্ডে, পার্থ চ্যাটার্জী, শাহিদ আমিন, সুমিত সরকার, গৌতম ভদ্র, দীপেশ চক্রবর্তী।
গুরুত্ব : ইতিহাসচর্চার উপকরণে অনেক নতুন সংযােজন ঘটেছে কারণ, সমস্ত কিছুর মাধ্যমেই সমাজ প্রতিফলিত হয়। তবে নতুন ইতিহাসকে সর্বজনগ্রাহ্য করে তুলতে হলে, সংগৃহীত তথ্যগুলিকে মিউজিয়াম, লেখ্যাগার, গ্রন্থাগারে রক্ষিত মৌলিক আকরের সঙ্গে হাতেকলমে যাচাই করে নিতে হয়।
২) আধুনিক ইতিহাসচর্চায় প্রত্যক্ষবাদী ও অ্যানাল গােষ্ঠীর ইতিহাসচর্চা সম্পর্কে আলােচনা করাে।
উত্তর:- ভূমিকা : আধুনিক ইতিহাস রচনা পদ্ধতির প্রধানতম দুটি দিক হল প্রত্যক্ষবাদী ধারা ও অ্যানাল গােষ্ঠীর ইতিহাসচর্চার ধারা।
প্রত্যক্ষবাদী ধারা : বৈজ্ঞানিক নীতির ওপর ভিত্তি করে অতীত ঘটনা ও তথ্যসমূহকে বিশ্লেষণ করে সত্য বা প্রকৃত জ্ঞানকে প্রতিষ্ঠা করার পদ্ধতি প্রত্যক্ষবাদী ইতিহাসচর্চা নামে পরিচিত। লিওপােল্ড ভন র্যাঙ্কে প্রবর্তিত এই ধরনের ইতিহাসচর্চার বৈশিষ্ট্য হল -
১. তথ্য ও নথিভিত্তিক : তথ্য ও নথিপত্রের ভিত্তিতে অতীত যেমন ছিল তেমনভাবেই উপস্থাপিত করে বস্তুনিষ্ঠ পক্ষপাতশূন্য ইতিহাস রচনা করা।
২. তথ্য উপস্থাপন : এই ইতিহাসচর্চায় অতীতের তথ্য উপস্থাপনের ওপর জোর দেওয়া হয় এবং একারণেই এই ইতিহাসচর্চায় ঐতিহাসিকরা তথ্যকেই ইতিহাস লেখার মূল আধার বলে মনে করেন।
৩. ঐতিহাসিকবর্গ : এই ধরনের ইতিহাসচর্চার সঙ্গে যুক্ত ঐতিহাসিকদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হলেন লিওপােল্ড ভন র্যাঙ্কে, জে, বি. বিউরি, লর্ড অ্যাক্টন প্রমুখ।
অ্যানাল গােষ্ঠী : বিশ শতকে ফ্রান্সে (১৯২৯ খ্রি.) ঐতিহাসিক মার্ক ব্লখ ও লুসিয়েন ফেভর দ্য অ্যানালস’ পত্রিকা প্রকাশের মাধ্যমে ইতিহাসচর্চায় যে নতুন ঘরানার সূচনা করেন তা ‘অ্যানাল স্কুল নামে পরিচিত। এই ধরনের ইতিহাসচর্চায়—
প্রথমত, সামাজিক ইতিহাসসহ সার্বিক ইতিহাস রচনার ওপর গুরুত্ব আরােপ করা হয়;
দ্বিতীয়ত, ভৌগােলিক কাঠামাে, আর্থ-সামাজিক পটভূমি, জনসংখ্যাতত্ত্ব, মানসিক প্রবণতার ওপর গুরুত্ব দান করে ইতিহাস চর্চার সূচনা করা হয়।
তৃতীয়ত, এই গােষ্ঠীর ঐতিহাসিকরা দীর্ঘ সময়ের পরিবর্তে স্বল্প সময় বা যুগের বিশ্লেষণ করার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন।
উপসংহার : প্রত্যক্ষবাদীদের মতে, ইতিহাস একটি বিজ্ঞান, তার বেশিও নয়, কমও নয়; কিন্তু অ্যানাল গােষ্ঠীর মতে, ইতিহাস হল এক সার্বিক সমন্বিত আলােচনা।
৩) নতুন সামাজিক ইতিহাসের প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করা।
উত্তর:- ভূমিকা : প্রচলিত ইতিহাসচর্চার একটি বিকল্প ও সংশােধনবাদী ধারা হিসেবে আধুনিক ইতিহাসচর্চার একটি বিশেষ দিক হল ১৯৬০ ও ১৯৭০-এর দশকে নতুন সামাজিক ইতিহাসচর্চা।
প্রেক্ষাপট : নতুন সামাজিক ইতিহাসচর্চার উদ্ভবের প্রেক্ষাপটে দেখা যায় যে -
১. উন্নয়নের প্রচেষ্টা : প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে উদার সমাজব্যবস্থার প্রবর্তন, জীবনযাত্রাসহ জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়নের প্রচেষ্টা মানবসমাজে অগ্রগতির সূচনা করায় সমাজের নীচুতলার মানুষ গুরুত্ব লাভ করে।
২. আন্দোলন ও মতাদর্শের বিকাশ : ১৯৬০ ও ১৯৭০-এর দশকে জাতিবিদ্বেষ, যুদ্ধবিরােধী মানসিকতা, নাগরিক অধিকার ও গণতান্ত্রিক মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের ফলে ঘটনার নতুন ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ শুরু হয়।
৩. অবহেলিত বিষয়ে গুরুত্ব দান : ঐতিহাসিক লরেন্স ডব্লু লেভাইন তার 'Black Culture'-এর উপর গবেষণালব্ধ বইয়ের প্রথম বাক্যেই ঘােষণা করেন যে, এটাই হল সেই সময় যখন ঐতিহাসিকদের নিজস্ব চেতনা বৃদ্ধি করা প্রয়ােজন এবং একইভাবে দরকার গবেষণার মাধ্যমে অবজ্ঞাপ্রাপ্ত ও অবহেলিত বিষয়গুলির প্রতি গুরুত্ব দান করা।
৪. ঐতিহাসিকদের নতুন দৃষ্টিভঙ্গি : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইংল্যান্ডের কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় ও মার্কসবাদী মতাদর্শে বিশ্বাসী ইউরােপের ঐতিহাসিকগণ সমাজের নীচুতলা থেকে ইতিহাস রচনায় সচেষ্ট হন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ঐতিহাসিক হলেন ক্রিস্টোফার হিল, এরিক জে হবসবম, প্যাট্রিক জয়েস, এডওয়ার্ড থম্পসন প্রমুখ।
উপসংহার : উপরােক্ত আলােচনা থেকে দেখা যায় যে, বিভিন্ন ঘটনার ফলশ্রুতি হিসেবে গড়ে ওঠা নতুন সামাজিক ইতিহাসের মূল বিষয় হল সমাজের সামগ্রিক ইতিহাস।
৪) নতুন সামাজিক ইতিহাস কী তা বিশ্লেষণ করাে।
উত্তর:- ভূমিকা : প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তীকালের বিভিন্ন ঘটনা ও মতাদর্শের ফলশ্রুতি হিসেবে ১৯৬০ ও ১৯৭০-এর দশকে গড়ে ওঠা নতুন সামাজিক ইতিহাসের মূল বিষয় হল সমাজের সামগ্রিক ইতিহাস।
সামাজিক ইতিহাসের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য : সামাজিক ইতিহাস-এর বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য হল—
১. সামগ্রিক সামাজিক ইতিহাস : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে সমাজের নীচুতলার মানুষ ও বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণির মানুষের ইতিহাস গুরুত্ব লাভ করে। কিন্তু পরবর্তীকালে বিভিন্ন গবেষণার মাধ্যমে এই ইতিহাসের পরিধি বিস্তৃত হয় ও তা নতুন সামাজিক ইতিহাসরূপে পরিচিত হয়।
২. ঘটনা-বঞ্চনার তথ্যনিষ্ঠ অনুসন্ধান : নতুন ধরনের ও সামাজিক ইতিহাসের বিষয়গত দিক হল শ্রমিক-কৃষক ইতিহাস, লিঙ্গগত ইতিহাস, কৃষাঙ্গ ইতিহাস, অভিপ্রয়াণের ইতিহাস, যুবক ও শিশুসহ পরিবারের ইতিহাস, গােষ্ঠী ইতিহাস, হিংসার ইতিহাস প্রভৃতি।
৩. সংশােধনবাদ : নতুন সামাজিক ইতিহাস হল প্রচলিত রাজনৈতিক, সামরিক, অর্থনৈতিক ও সাংবিধানিক ইতিহাসের বিপরীতে এক সংশােধনবাদী ইতিহাস।
৪. প্রাতিষ্ঠানিক : নতুন সামাজিক ইতিহাসচর্চার জন্য ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘দ্য সােশ্যাল সায়েন্স হিস্ট্রি অ্যাসােসিয়েশন, যার মুখপত্র হল ‘সােশ্যাল সায়েন্স হিস্ট্রি'।
উপসংহার : নতুন সামাজিক ইতিহাস সমালােচনামুক্ত নয়। অনেকক্ষেত্রেই এই ইতিহাসে প্রচলিত ইতিহাসকে খণ্ডন করা হয়। এবং নতুন তথ্য ও সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়।
৫) নিম্নবর্গীয় ইতিহাস বিশ্লেষণ করাে।
উত্তর:- ভূমিকা : ইংরেজি অভিধানে ‘সাবান বা নিম্নবর্গে কথা বােঝাতে সামরিক বাহিনীর নিম্নপদস্থ অফিসারদের বােঝায়। কার্ল মার্কস নিম্নবর্গীয়দের বলেছেন ‘প্রােলেতারিয়েত”। ইতালির মার্কসবাদী বুদ্ধিজীবী আন্তোনিও গ্রামশি ইতিহাসচর্চায় প্রথম এই শব্দটি ব্যবহার করেন। তিনি এই প্রােলেতারিয়েতদের জীবনচর্য ও আচার-আচরণের ওপরেই বেশি জোর দিয়েছেন।
নিম্নবর্গের ইতিহাস : ভারতে নিম্নবর্গীয় ইতিহাসচর্চার প্রবর্তক রণজিৎ গুহ নিম্নবর্গ বলতে বুঝিয়েছেন কৃষক, শ্রমিক, শহুরে জনতা এবং নিম্নবর্গের মহিলাদেরও। নিম্নবর্গের ইতিহাস বলতে বােঝায়, সমাজের নীচুতলার মানুষের ইতিহাসকে। ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দে রণজিৎ গুহ নিম্নবর্গের ইতিহাস রচনা পদ্ধতির কথা তুলে ধরেন যা 'সাবল্টার্ন স্টাডিজ' নামে পরিচিত।
বৈশিষ্ট্য : ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলি হল—
প্রথমত, প্রচলিত ইতিহাসচর্চায় সমাজের উচ্চবর্গের ভূমিকার। ওপর গুরুত্ব আরােপ করা হত, কিন্তু এই ইতিহাসচর্চার নিম্নবর্গ। অর্থাৎ, কৃষক, শ্রমিক, শহুরে জনতা, আদিবাসী এবং সমাজের নিম্নস্তরের মানুষ ও মহিলাদের ভূমিকাসহ বিক্ষোভ, বিদ্রোহ, অবস্থান ও মর্যাদার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, নিম্নবর্গের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিশ্লেষণের পাশাপাশি কৃষক, শ্রমিক প্রভৃতি শ্রেণির ‘শ্রেণি-চৈতন্য’-কে তুলে ধরা হয়েছে।
তৃতীয়ত, নিম্নবর্গের ঐতিহাসিকদের মধ্যে রণজিৎ গুহ ছাড়া অন্যান্য উল্লেখযােগ্য ঐতিহাসিক হলেন জ্ঞান পাণ্ডে, স্টিফেন হেনিংহাম, দীপেশ চক্রবর্তী, গৌতম ভদ্র, শাহিদ আমিন প্রমুখ।
৬) খেলার ইতিহাসচর্চার বৈশিষ্ট্যগুলি লেখাে।
উত্তর:- ভূমিকা : প্রাচীন গ্রিসে অলিম্পিক ক্রীড়া প্রতিযােগিতার মাধ্যমে খেলাধুলার যে ঐতিহ্য শুরু হয়েছিল আজ তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ফুটবল, ক্রিকেট, হকি, টেনিস, গল্ফ, পােলাে প্রভৃতি খেলা। বিশ শতকের শেষ দুই দশক থেকে এই সমস্ত খেলা সম্পর্ক যে ইতিহাসচর্চা শুরু হয়েছে তা খেলার ইতিহাস নামে পরিচিত।
বৈশিষ্ট্য : খেলার ইতিহাসচর্চার বৈশিষ্ট্যগুলি হল—
১. উদ্ভব ও বিবর্তন : বিভিন্ন খেলার উদ্ভব ও বিবর্তন কীভাবে হয়েছিল এবং এগুলির সঙ্গে যে দেশগুলি ও তাদের পৃষ্ঠপােষকরা জড়িয়ে ছিলেন তাঁদের চিহ্নিত করা।
২. সরঞ্জাম : বিভিন্ন খেলার বিভিন্ন রকম সরঞ্জাম শিল্পবিপ্লবের আগে কেমন ছিল এবং শিল্পবিপ্লবের পরে কেমন হল তা চিহ্নিত করাই এই ইতিহাসের একটি বিশিষ্ট দিক।
৩. ঔপনিবেশিক শাসনে সংহতি : ঔপনিবেশিক শক্তিগুলি তাদের উপনিবেশে ক্রিকেট, ফুটবল, হকি, টেনিস খেলা চালু করে ঔপনিবেশিক শাসনে সংহতি আনতে চেয়েছিল। এ প্রসঙ্গে সাম্রাজ্যবাদী দেশ ইংল্যান্ড কর্তৃক উপনিবেশগুলিতে সংহতি প্রতিষ্ঠার জন্য ক্রিকেট খেলাকে ব্যবহার করার কথা বলা যায়।
৪. জাতীয়তাবাদের উন্মেষ : খেলাকে কেন্দ্র করে দেশীয় জনগণের মধ্যে কীভাবে বিদেশি শাসনের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে তা ব্যাখ্যা করা এই ইতিহাসের একটি দিক।
উপসংহার : কেবলমাত্র খেলার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে খেলার সঙ্গে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় সংস্কৃতি কীভাবে জড়িয়ে পড়েছে তা অনুসন্ধান করাও এই ইতিহাসচর্চার বৈশিষ্ট্য।
৭) খেলাধুলার ইতিহাসকে কেন ইতিহাসের অঙ্গীভূত করা হয়েছে ?
উত্তর:- ভূমিকা : আধুনিক সভ্যতায় অবসরবিনােদন ও শারীরিক দক্ষতা প্রদর্শনের একটি বিশেষ মাধ্যম হল খেলা বা ক্রীড়া প্রতিযােগিতা। বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে ক্রিকেট, ফুটবল, হকি, টেনিস, গলফ, দাবা, রাগবি প্রভৃতি খেলার উদ্ভব, বিবর্তন, প্রসার ও প্রভাব সম্পর্কে চর্চা শুরু হয় যা খেলার ইতিহাস নামে পরিচিত। খেলাধুলাকে ইতিহাসের অঙ্গীভূত করা হয়েছে, কারণ—
১. ঐতিহ্য সংরক্ষণ : খেলাধুলা একদিকে যেমন অবসর বিনােদনের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম, তেমনি খেলাধুলার মাধ্যমে মানুষ, দেশ ও জাতির ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং জাতীয়তাবাদী মনােভাব প্রকাশ পায়।
২. সামাজিক ইতিহাসের অঙ্গ : সমাজে মানুষের সঙ্গে খেলাধুলার সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর হওয়ায় তা মানুষের কার্যকলাপরূপে বিবেচিত হয়েছে। তাই খেলাধুলা আজ সামাজিক ইতিহাসের অঙ্গ।
৩. খেলাধুলার অতীত নির্মাণ : বিভিন্ন খেলার উদ্ভব ও বিবর্তন কীভাবে হয়েছিল এবং খেলার সরঞ্জাম কেমন ছিল তার অতীত নির্মাণের জন্যও খেলাকে ইতিহাসের অঙ্গীভূত করা হয়েছে।
৪. প্রশাসনিক সংহতির মাধ্যম :- ঔপনিবেশিক শক্তির প্রসার ও সংহতি সাধনে খেলাধূলা ছিল এক ধরনের ইতিবাচক অস্ত্র অর্থাৎ, ঔপনিবেশিক শক্তিগুলি তাদের উপনিবেশের শাসনে সংহতি আনতে ক্রিকেট, ফুটবল, হকি, টেনিস খেলাকে যেভাবে ব্যবহার করেছিল তা আজ ইতিহাস।
৫. আন্তঃরাষ্ট্রীয় সৌহার্দ্য : প্রাচীনকালে গ্রিসে অলিম্পিক প্রতিযােগিতার ক-দিন যুদ্ধ বন্ধ রেখে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও আন্তঃরাষ্ট্রীয় সুসম্পর্ক গড়ে তােলার ওপরে জোর দেওয়া হত। বর্তমানেও আন্তর্জাতিক খেলাগুলির মাধ্যমে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে সৌহার্দ্য ও শান্তি রক্ষার বিষয়টি গুরুত্ব লাভ করেছে।
৮) আধুনিক ভারতে খেলাধুলার ইতিহাসের গতিপ্রকৃতি আলোচনা করো।
উত্তর:- ভূমিকা : ভারতে দেশজ খেলাধুলার মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিল শতরঞ্জ, পাশা, বাঘবন্দি, হাডুডু, কুস্তি, গেণ্ডুয়া, গুলতি খেলা।
খেলাধুলার গতিপ্রকৃতি : আধুনিক ভারতে দেশজ খেলার পাশাপাশি বিদেশি খেলার আগমন ঘটে, যেমন—
১. ক্রিকেট : ১৭২১ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডের সূত্র ধরেই ভারতে ক্রিকেট খেলার সূচনা হলেও তা ভারতস্থ ইংরেজ সামরিক বাহিনী ও শ্বেতাঙ্গদের ক্লাব বা জিমখানার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। পরবর্তীকালে -
প্রথমত, আঠারাে শতকের শেষে ভারতে প্রথম ক্রিকেট ক্লাব রূপে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয় ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাব’ (১৭৯২ খ্রিস্টাব্দ) এবং ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে বােম্বাইয়ে পারসিদের ‘ওরিয়েন্টাল ক্রিকেট ক্লাব’;
দ্বিতীয়ত, ভারতে হিন্দু, পারসি, মুসলিম ও খ্রিস্টান দলের মধ্যে সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে ক্রিকেট টুর্নামেন্ট খেলানাে হত।
২. হকি : ভারতে মূলত ইংরেজ সৈন্যবাহিনীর হাত ধরেই হকি খেলার প্রসার ঘটে এবং কলকাতায় ভারতের প্রথম হকি ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয় (১৮৮৫-৮৬ খ্রিস্টাব্দ)। বিশ শতকে ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে অলিম্পিক গেমসে ভারত প্রথম অংশগ্রহণ করে এবং শেষ পর্যন্ত ফাইনাল খেলায় হল্যান্ডের কাছে ভারত ৩-০ গােলে পরাজিত হয়। ধ্যানচাঁদ ছিলেন ভারতের একজন বিখ্যাত হকি খেলােয়াড়।
৩. ফুটবল : ইংরেজদের হাত ধরে ভারতে ফুটবল খেলার সূচনা হলেও নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারী ছিলেন ভারতীয় ফুটবলের জনক’। পরবর্তীকালে ‘মােহনবাগান অ্যাথলেটিক ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয় (১৮৮৯ খ্রি.) এবং ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে আই এফ এ শিল্ড প্রতিযােগিতায় ইংরেজদের ইস্ট ইয়র্ক ক্লাবকে হারিয়ে দেয়।
৪. ইতিহাসচর্চা : ১৯৭০-এর দশকে ইউরােপে খেলাধুলার ইতিহাস সম্পর্কে চর্চা শুরু হলেও ভারতে তা শুরু হয় ১৯৮০-র দশকে এবং এক্ষেত্রে উল্লেখযােগ্য গবেষকরা হলেন সৌমেনচন্দ্র মিত্র, আশীষ নন্দী, বােরিয়া মজুমদার, রামচন্দ্র গুহ, কৌশিক বন্দ্যোপাধ্যায়।
উপসংহার : ভারতে খেলাধুলার ইতিহাসে টেনিস, পােলাে, গলফ, রাগবি, বাস্কেটবল খেলারও উল্লেখযােগ্য ভূমিকা ছিল। ভারতীয়দের কাছে আধুনিক খেলাধুলা অবসরবিনােদন ও পৌরুষ প্রকাশের মাধ্যম হলেও তা ছিল পরাধীন ভারতে জাতীয়তাবাদ প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম।
৯) ভারতীয় ফুটবল খেলা কীভাবে জাতীয়তাবােধে উন্নীত হয়?
উত্তর:- ভূমিকা : আধুনিক ভারতে দেশজ খেলাধুলার (শতরঞ্জ, পাশা, বাঘবন্দী, হাডু-ডু, কুস্তি, গেণ্ডুয়া ও গুলতি) পাশাপাশি ইংরেজ শাসকদের হাত ধরে ক্রিকেট, হকি ও ফুটবল খেলা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
জাতীয়তাবাদের উন্মেষ : ভারতে ফুটবল, ক্রিকেট, হকি খেলার প্রসার ইংরেজদের সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদী প্রকল্প হলেও তা ভারতীয়দের কাছে ক্রমশ জাতীয়তাবাদ প্রকাশে মাধ্যম হয়ে ওঠে -
১. পৌরুষ প্রদর্শন : ইংরেজ শাসনের শুরু থেকেই ইংরেজসহ ইউরােপীয়দের দৃষ্টিভঙ্গিতে বাঙালি জাতিসহ ভারতীয়রা ছিল ‘দুর্বল’, ‘অক্ষম’, কাপুরুষােচিত’, কিন্তু ফুটবল খেলার মাধ্যমে ভারতীয়রা তাদের প্রতি এই দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিবাদ করেছিল ও তাদের পৌরুষ প্রদর্শন করেছিল।
২. ভারতীয় ফুটবলের জনক : নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারীকে ভারতীয় ফুটবলের জনক বলা হয়, কারণ—
প্রথমত, তিনি কিশাের বয়সেই বয়েজ ক্লাব, ‘ফ্রেন্ডস ক্লাব, ‘ওয়েলিংটন ক্লাব’ প্রভৃতির সংগঠকরূপে বাংলার ফুটবলসহ খেলাধুলাের ক্ষেত্রে এক নবজাগরণ আনেন। দ্বিতীয়ত, দেশবাসীকে ফুটবল খেলার মাধ্যমে শারীরিকভাবে শক্তপােক্ত করে তুলে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটাতে চেয়েছিলেন।
৩. মােহনবাগানের জয়লাভ : ইংরেজরা যেখানে বুট পরে ফুটবল খেলত, সেখানে দরিদ্র ভারতীয়দের খেলতে হত খালি পায়ে। খালি পায়ে বুটপরা খেলােয়াড়দের মােকাবিলা করা খুব সহজ ছিল না। তাই ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে আই এফ এ শিল্ড প্রতিযােগিতায় মােহনবাগান দলের ভারতীয় খেলােয়াড়রা যখন খালি পায়ে ফুটবল খেলে ২-১ গােলে ইংরেজদের ইস্ট ইয়র্ক ক্লাবকে হারিয়ে দেয়, তখন তা পরাধীন দেশের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার করার মতােই এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হয়ে ওঠে। এই ভাবেই ভারতীয় ফুটবল ভারতীয় জাতীয়তাবােধকে উজ্জীবিত করে।
১০. খাদ্যাভ্যাসের ইতিহাসচর্চার বৈশিষ্ট্যগুলি লেখাে।
উত্তর:- ভূমিকা : আধুনিক ইতিহাসচর্চার বৈচিত্র্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল খাদ্যাভ্যাসের ইতিহাসচর্চা।
বৈশিষ্ট্য : খাদ্যাভ্যাসের ইতিহাসচতচর্চার বৈশিষ্ট্যগুলি হল—
১. পৃথক খাদ্যাভ্যাসের কারণ : মানুষের রুচি ও সামর্থ্য, আবহাওয়া ও জলবায়ু, ধর্মীয় রীতি ও বিধিনিষেধ কীভাবে মানুষের পৃথক পৃথক খাদ্যাভ্যাস গড়ে তােলে তা চিহ্নিত করা।
২. খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তনে ঔপনিবেশিক প্রভাব : এশিয়া-আফ্রিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠার ফলে শাসক ও শাসিত উভয়েরই খাদ্যাভ্যাসে কীভাবে পরিবর্তন এসেছিল তা চিহ্নিত করা।
৩. শাসিত খাদ্যগ্রহণ ও বর্জনের কারণ : স্বাধীন মানুষেরা কেন ও কীভাবে খাদ্য গ্রহণ-বর্জন করে তা তুলে ধরা এই ইতিহাসের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। আবার ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনস্থ শাসিত
ও শাসকদের খাদ্যগ্রহণ ও বর্জনকে তুলে ধরা এই ইতিহাসের আলােচ্য বিষয়।
৪. খাদ্যাভ্যাস ও জাতীয়তাবাদ : উপনিবেশের জনগণ দেশজ খাদ্যাভ্যাস সংস্কৃতিকে ব্যবহার করে বিদেশি শাসনের বিরুদ্ধে কীভাবে প্রতিরােধ গড়ে তােলে তা ব্যাখ্যা করাও হল এই ইতিহাসচর্চার বৈশিষ্ট্য।
উপসংহার : খাদ্যাভ্যাসের ইতিহাসচর্চার মাধ্যমে স্বাস্থ্যবিধি অনুযায়ী খাবার সংক্রান্ত ইতিহাসের পাশাপাশি হাজার হাজার বছরের খাবার প্রক্রিয়াকরণ ও হারিয়ে যাওয়া খাবারের রন্ধন প্রণালীও তুলে ধরা হয়েছে। খাদ্যাভ্যাস সমাজ ও সংস্কৃতির সঙ্গে কীভাবে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে রয়েছে তাও উপলব্ধি করা সম্ভব হয়েছে।
১১. ভারতীয়দের খাদ্যাভ্যাস আলােচনা করে ঔপনিবেশিক পর্বে তার কী পরিবর্তন হয়েছিল তা আলােচনা করাে।
উত্তর:- ভূমিকা : রাজনীতি, অর্থনীতি ও ভৌগােলিক প্রভাবে ভারতের বর্তমান খাদ্যাভ্যাস প্রভাবিত হয়েছে। ভারতস্থ বিদেশি শাসকদের কাছ থেকে আমরা বিদেশিদের অনেক খাদ্যাভ্যাস আয়ত্ত করেছি ভারতের খাদ্যাভ্যাসের দিক বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় -
১. খাদ্য বৈচিত্র্য : ভারতের জলবায়ু ও ভূপ্রকৃতির তারতম্য অনুযায়ী কোথাও ভাত, কোথাও রুটি, কোথাও জোয়ার-বাজরা জাতীয় শস্য থেকে তৈরি মিলেট’ হল ভারতীয়দের প্রিয় খাদ্য।
২. বিদেশি খাদ্য : প্রাক্-ঔপনিবেশিক পর্বে ভারতীয় খাদ্য তালিকায় যে সমস্ত বিদেশি খাদ্য ছিল সেগুলি হল আলু, চিনাবাদাম, ভুট্টা, টম্যাটো, সয়াবিন বা সিম, পালং শাক। পাশাপাশি আমিষ খাবারও ছিল, যেমন—কাচ্চি ও পাক্কি বিরিয়ানি, কাবাব, মাছের বিভিন্ন পদ বা তরকারি।
৩. রন্ধনশৈলী : খাদ্যাভ্যাসের ইতিহাসচর্চায় ভারতীয় খাবার ও রন্ধনশৈলী বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থান লাভ করেছে, কারণ ভারতীয়। রন্ধনপ্রণালীর মধ্যে যে ব্যাপক বৈচিত্র্য রয়েছে, তা সমগ্র ইউরােপের রন্ধনশৈলীর সঙ্গে তুলনীয়। ভারতে মূলত চার ধরনের রন্ধনশৈলী রয়েছে, যেমন- প্রথমত, উত্তর ভারতীয় রন্ধনশৈলী (বেনারস, ( কাশ্মীর, দিল্লি, পাঞ্জাব ও রাজস্থান); দ্বিতীয়ত, দক্ষিণ ভারতীয় রন্ধনশৈলী (অন্ত্রপ্রদেশ, কর্ণাটক, কেরল ও তামিলনাড়ু); তৃতীয়ত, পূর্ব ভারতীয় রন্ধনশৈলী (বাংলা ও অসম); চতুর্থত, পশ্চিম ভারতীয় রন্ধনশৈলী (মহারাষ্ট্র, মালব ও গুজরাট)।
ঔপনিবেশিক পর্বে পরিবর্তন : ঔপনিবেশিক শাসনপর্বে প্রথমত, ভারতীয়রা, ভাত, ডাল, সবজি, রুটি ও আমিষ (মাছ, মাংস) খাবারের পাশাপাশি পাশ্চাত্য খাবারের প্রতিও আকৃষ্ট হয়েছিল।
দ্বিতীয়ত, বিদেশি খাবারের প্রতি এই আকর্ষণ শহরে বসবাসকারী ইংরেজি শিক্ষিত উচ্চবিত্ত (শিক্ষক, ডাক্তার, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী ও জমিদার শ্রেণি) শ্রেণির একাংশের মধ্যেই সীমিত ছিল।
তৃতীয়ত, এঁরা শাসক ইংরেজদের ভােজসভায় উপস্থিত হয়ে এদেশীয় সামাজিক বিধিনিষেধ ভেঙে নিষিদ্ধ মাংস, চা, কফি, সিগারেট ও মদ্যপান করত।
১২) শিল্পচর্চার ইতিহাসের বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ করাে।
উত্তর:- ভূমিকা : শিল্পচর্চার ইতিহাসের অন্তর্গত বিষয়গুলি হল সংগীত, নৃত্য, নাটক ও চলচ্চিত্র।
শিল্পচর্চার বিভিন্ন দিক : ইউরােপে রেনেসাঁসের সময়কাল থেকেই চলচ্চিত্র ছাড়া অন্যান্য শিল্পচর্চার ইতিহাসের সূচনা হয়েছিল। এর বিভিন্ন দিকগুলি হল—
১. আকার বা ধরন চিহ্নিতকরণ : শিল্পচর্চার অন্তর্গত বিষয়গুলির উদ্ভব, ধরন ও রীতির বিবর্তনকে চিহ্নিত করে এই বিষয়গুলির ইতিহাস নির্মাণ করাই এর প্রধান উদ্দেশ্য।
২. নান্দনিকতা : সংগীত, নৃত্য, নাটক ও চলচ্চিত্র-এর সঙ্গে যুক্ত নান্দনিকতার বিষয়টি কীভাবে শ্রোতা ও দর্শকদের চিত্ত বিনােদনের পাশাপাশি সামাজিক ও মানসিক সংহতি গড়ে তুলেছিল তা চিহ্নিত করাই এই ইতিহাসের বৈশিষ্ট্য।
৩. প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব : শিল্পচর্চাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা সংগীতকেন্দ্র, নৃত্যশালা, নাট্যকেন্দ্র বা রঙ্গমঞ, সিনেমা হল এবং এইসব প্রতিষ্ঠান ও কেন্দ্রগুলির পৃষ্ঠপােষকদের চিহ্নিত করে তাদের অবদানের মূল্যায়ন করাও এই ইতিহাসের এক বিশিষ্ট দিক।
৪. রাজনৈতিক গুরুত্ব : সংগীত, নৃত্য, নাটক ও চলচ্চিত্রের মাধ্যমে একটি দেশের সাংস্কৃতিক সত্তা প্রকাশিত হয়। এই সত্তা কীভাবে একটি দেশের রাজনৈতিক সংহতি স্বাধীনতা সংগ্রামকে উজ্জীবিত করে তােলে তা চিহ্নিত করাও শিল্পচর্চার ইতিহাসের বৈশিষ্ট্য।
উপসংহার : শিল্পচর্চার সঙ্গে যুক্ত শিল্পী ও সংগঠনের অভিজ্ঞতা ও শিল্পচর্চা সম্পর্কিত পরীক্ষানিরীক্ষার মূল্যায়ন করার মাধ্যমে কলাকুশলীদের ইতিহাসও গড়ে ওঠে।
১৩) ভারতে চলচ্চিত্রের আদিপর্ব বিশ্লেষণ করে চলচ্চিত্র শিল্পে সত্যজিৎ রায়ের অবদান আলােচনা করাে।
উত্তর:- চলচ্চিত্রের আদিপর্ব : ঔপনিবেশিক শাসনপর্বে ভারতে ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে হরিশ্চন্দ্র সখারাম ভাতওয়াডেকর ‘দ্য রেস্টলারস’ নামক একটি সচল ও নির্বাক ছবি নির্মাণ করেন। পরবর্তীকালে ধুন্দিরাজ গােবিন্দ ফালকে তৈরি করেন রাজা হরিশ্চন্দ্র’ নামক চলচ্চিত্র (১৯১৩ খ্রি.)। তবে, ‘আলম আরা’ চলচ্চিত্রটি ছিল (১৯৩১ খ্রি.) ভারতের প্রথম পূর্ণ দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র। ভারতে হীরালাল সেন প্রথম চলচ্চিত্র প্রদর্শনের ব্যবস্থা করেন এবং এই উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠা করেন 'রয়্যাল বায়ােস্কোপ কোম্পানি' ।
ভারতীয় চলচ্চিত্র শিল্পে সত্যজিৎ রায়ের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
১. চলচ্চিত্র নির্মাণ : বিজ্ঞাপন জগতের সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে সত্যজিৎ যখন চলচ্চিত্র নির্মাণে আত্মনিয়ােগ করেন এবং তার বিশ্ববিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘পথের পাঁচালী’ ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে মুক্তি পায়, তখন থেকেই ভারতীয় চলচ্চিত্রে এক নতুন যুগ শুরু হয় বলা যেতে পারে।
২. সত্যজিতের বিখ্যাত চলচ্চিত্রসমূহ : ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যুকাল পর্যন্ত সময়ে তিনি ‘অপরাজিত’, ‘অপুর সংসার’, ‘দেবী’, জলসাঘর’, ‘চারুলতা', ‘গুপিগাইন-বাঘাবাইন’, ‘হীরক রাজার দেশে’, ‘সােনার কেল্লা, শাখাপ্রশাখা’, ‘আগন্তুক’ প্রভৃতি একের পর এক আন্তর্জাতিক মানের চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। ভারতীয় চলচ্চিত্রকে তিনি অস্কার-সহ বহু আন্তর্জাতিক পুরস্কার এনে দেন।
১৪) ঔপনিবেশিক পর্বে বাংলার সংগীতচর্চার ইতিহাস আলােচনা করাে।
উত্তর:- ঔপনিবেশিক বাংলায় দেশজ ও পাশ্চাত্য প্রভাবের ফলে সংগীতচর্চার ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব পরিবর্তন এসেছিল, যেমন-
১. রবীন্দ্র-পূর্ব সময় : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্ববর্তী সময়ে রাধামােহন সেন, সৌরীন্দ্রমােহন ঠাকুর, মনােমােহন বসু যুগের ভাব অনুযায়ী গান রচনা করেন। ফলে বাংলা ধ্রুপদ, খেয়াল, টপ্পা প্রভৃতির প্রবর্তন ও উন্নতি ঘটে। এ ছাড়া সংগীতের উন্নতির জন্য বিকল্প প্রতিষ্ঠান ও সংগীত বিদ্যালয়ও স্থাপন করেছিলেন।
২. নাট্যগীতি : জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরই সর্বপ্রথম বিভিন্ন ধরনের বাদ্যযন্ত্র সহযােগে বাংলা নাট্যগীতির ক্ষেত্রে দেশি-বিদেশি সুরের সমন্বয় ঘটান। পরবর্তীকালে গিরিশচন্দ্র ঘােষ, ক্ষিরােদাপ্রসাদ ও দ্বিজেন্দ্রলাল রায় এই ধারার নাট্যগীতির আরও উন্নতি সাধন করেন।
৩. রবীন্দ্রনাথ ও সমকাল : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দেশি গানের ঐতিহ্য (বাউল, কীর্তন, ভাটিয়ালি), মার্গ সংগীত ও বিলিতি সুরের বৈচিত্র্যের সমন্বয়ে নিজস্ব সংগীত তৈরি করেন, যা রবীন্দ্র সংগীত নামে পরিচিত।
৪. অন্যান্য গান : বাংলা গানের ক্ষেত্রে নজরুল ইসলামের নজরুলগীতিও বিশিষ্ট স্থান অধিকার করেছিল। এ ছাড়া অতুলপ্রসাদ সেন, রজনীকান্ত সেন, মুকুন্দ দাসের সংগীতও উল্লেখের দাবি রাখে।
১৫. পোশাক-পরিচ্ছদের ইতিহাসচর্চার মূল বৈশিষ্ট্য আলোচনা করাে।
উত্তর:- ভূমিকা : আধুনিক ইতিহাসচর্চার বৈচিত্র্যের একটি দিক হল পোশাক-পরিচ্ছদের ইতিহাস, যা কিনা সভ্যতার বিকাশ ও বিবর্তনের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত।
বৈশিষ্ট্য : পােশাক-পরিচ্ছদের ইতিহাসচর্চার বৈশিষ্ট্যগুলি হল-
১. উদ্ভব ও বিবর্তন : পেপাশাক-পরিচ্ছদের উদ্ভব ও তার বিবর্তনকে চিহ্নিত করে মানবসভ্যতার বিকাশে তার গুরুত্বকে তুলে ধরা এবং পােশাক কীভাবে কর্তৃত্ব ও আভিজাত্যের মাপকাঠি হয়ে উঠেছিল তা ব্যাখ্যা করা এই ইতিহাসের অন্যতম উদ্দেশ্য।
২. পােশাকের ভিন্নতা : এই ইতিহাসচর্চায় শিল্পবিপ্লবের পূর্বের এবং শিল্পবিপ্লব ও শিল্পবিপ্লবের উত্তর পর্বের পােশাকের ধরন ও বিন্যাসকে চিহ্নিত করা হয়। পােশাক-পরিচ্ছদের ইতিহাস সমাজের অভিজাত ও সাধারণ মানুষের পােশাকের ভিন্নতার তাৎপর্য ব্যাখ্যা করে।
৩. স্বাস্থ্যবিধি : আঠারাে ও উনিশ শতকে ইউরােপে বিশেষত ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সে নারীদের পােশাকের আঁটোসাটো ধরন ও বাহুল্যতা ক্রমশই নারীদের শারীরিক অসুস্থতার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাই স্বাস্থ্যসম্মত পােশাকের উদ্ভব ও তার বিবর্তনকে চিহ্নিত করাও এই ইতিহাসের বিশেষ বৈশিষ্ট্য।
৪. রাজনৈতিক তাৎপর্য : আধুনিক বিশ্বে ঔপনিবেশিক শাসনপর্বে পাশ্চাত্য পােশাক কীভাবে উপনিবেশগুলিতে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে তার কারণ চিহ্নিত করার পাশাপাশি দেশজ পােশাক সংস্কৃতি কীভাবে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে সংহতি দান করে তাও খুঁজে দেখে এই ইতিহাস।
উপসংহার : এভাবে দেখা যায়, পােশাকের ইতিহাসের সঙ্গে সমাজ-সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও রাজনৈতিক ইতিহাসও যুক্ত থাকায় পােশাকের ইতিহাসচর্চার ইতিহাস সামগ্রিক ইতিহাসে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।
১৬) যানবাহন-যােগাযােগ ব্যবস্থার ইতিহাসচর্চার বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করাে।
উত্তর:- ভূমিকা : ১৯৬০ থেকে ১৯৭০-এর দশকে আধুনিক ইতিহাসচর্চার বৈচিত্র্যের অন্যতম দিক হিসেবে যানবাহন ও যােগাযােগ ব্যবস্থার ইতিহাসচর্চার সূচনা হয়।
বৈশিষ্ট্য : যানবাহন-যােগাযােগ ব্যবস্থার ইতিহাসের বৈশিষ্ট্যগুলি হল—
১. পরিধি : যানবাহন মূলত তিন ধরনের যথা—জল, স্থল ও আকাশপথের যানবাহন। অন্যদিকে, যােগাযােগ ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ। ক্ষেত্র হল টেলিগ্রাফ, টেলিফোন, চিঠিপত্র, রেডিয়াে, টিভি, ফ্যাক্স, মােবাইল ফোন প্রভৃতি।
২. উদ্ভব ও উন্নতি : এই ইতিহাসচর্চায় চাকা আবিষ্কার থেকে শুরু করে যানবাহনের উদ্ভব ও তার বিবর্তন এবং যানবাহন ও যােগাযােগ ব্যবস্থার বিভিন্ন ধরনকে চিহ্নিত করা হয়। এর পাশাপাশি প্রাচীন যানবাহন ও যােগাযােগ ব্যবস্থার সঙ্গে সমসাময়িক যানবাহন ও যােগাযােগ ব্যবস্থার পাথর্ক্য ও অগ্রগতি চিহ্নিত করাও এই। ইতিহাসচর্চার অন্যতম উদ্দেশ্য।
৩. প্রযুক্তিগত উন্নতি : যানবাহন ও যােগাযােগ ব্যবস্থার উন্নয়নের মূলে থাকে যে প্রযুক্তিগত উন্নতি, সেই অগ্রগতিকে খুঁজে বের করাও এই ইতিহাসচর্চার বিশেষ বৈশিষ্ট্য।
৪. প্রভাব : বাণিজ্য, যাতায়াত, সাম্রাজ্যবাদের প্রসার, নগরায়ণ ও পরিবেশ প্রভৃতি ক্ষেত্রে পরিবহণ ও যােগাযােগ ব্যবস্থার প্রভাবকে চিহ্নিত করে এই ইতিহাস বৈশিষ্ট্য।
উপসংহার : যানবাহন ও যােগাযােগ ব্যবস্থা আমাদের। জীবনকে সহজ করে তুলেছে; যানবাহন ও যােগাযােগ ব্যবস্থার ইতিহাস একটি রাষ্ট্রে সংহতি ও জাতীয়তাবাদ যেমন সৃষ্টি করে, তেমনি তা আন্তর্জাতিকতাবাদের বিকাশেও সাহায্য করে।
১৭) দৃশ্যশিল্পের ইতিহাস ও তার বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করাে।
উত্তর:- ভূমিকা : আধুনিক ইতিহাসচর্চার বৈচিত্র্যের একটি দিক হল দৃশ্যশিল্পের ইতিহাস। এর প্রধান দুটি বিষয় হল ছবি আঁকা। ও ফোটোগ্রাফি।
ইতিহাস : মানুষ যখন তার মনের ভাব প্রকাশের জন্য রং ও তুলির মাধ্যমে কোনাে দৃশ্য নির্মাণ করে, তখন তা ছবি আঁকা নামে পরিচিত। অন্যদিকে ক্যামেরার মাধ্যমে যখন কোনাে বাস্তব জিনিসের ছবি তােলা হয় এবং তখন তা ফোটোগ্রাফি নামে পরিচিত। খ্রিস্টপূর্ব ৮০০০ অব্দ থেকেই গুহাচিত্র অঙ্কনের মাধ্যমে ছবি আঁকার সূচনা হয় এবং ফোটোগ্রাফির সূচনা হয়। ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে।
বৈশিষ্ট্য : দৃশ্যশিল্পের ইতিহাসচর্চার বৈশিষ্ট্য আলােচনা করলে দেখা যায় যে -
১. উদ্ভব ও বিবর্তন : ছবি আঁকা ও ফোটোগ্রাফির উদ্ভব এবং তার যুগ নির্ধারণ ও শ্রেণিবিভক্তিকরণের মাধ্যমে দৃশ্য-শিল্পের ইতিহাস গড়ে ওঠে। এর মাধ্যমে মানুষ ও প্রকৃতি বা পরিবেশের সম্পর্ককে চিহ্নিত করা যায়।
২. সংস্কৃতিতে প্রভাব : দৃশ্যশিল্প মানবসভ্যতা ও সংস্কৃতিতে কীভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল তা চিহ্নিত করা এই ইতিহাসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
৩. পৃষ্ঠপােষকতা : দৃশ্যশিল্পের ইতিহাসে শিল্পী এবং ফোটোগ্রাফার বা আলােকচিত্রীদের অভিজ্ঞতা এবং তাদের পৃষ্ঠপােষকদের ইতিহাস খুঁজে বের করাও ওই ইতিহাসচর্চার বৈশিষ্ট্য।
৪. শিল্প-প্রতিষ্ঠান : দৃশ্য শিল্পের উন্নতির জন্য বিজ্ঞানসম্মত প্রশিক্ষণের লক্ষ্য নিয়ে যে সমস্ত প্রতিষ্ঠান ও রীতি গড়ে উঠেছে তার ইতিহাস আলােচনা ও এই ইতিহাসচর্চার অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
১৮) স্থাপত্য ইতিহাস বলতে কী বােঝায়? অথবা, স্থাপত্য কর্মের ইতিহাসের উল্লেখযােগ্য বৈশিষ্ট্যগুলি কী কী?
উত্তর:- ভূমিকা : প্রাচীন স্থাপত্যগুলি হল ইতিহাসের সাক্ষী, তাই স্থাপত্যের ইতিহাস হল অনেকটাই জীবন্ত ইতিহাস।
স্থাপত্য ইতিহাসের বৈশিষ্ট্য : ইউরােপে রেনেসাঁসের সময় থেকেই স্থাপত্য ও স্থাপত্য নির্মাণকার্যে যুক্ত কারিগরদের সম্পর্কে স্থাপত্যের ইতিহাস লেখার কাজ শুরু হয়। এর বৈশিষ্ট্যগুলি হল—
১. প্রতিষ্ঠাকাল : স্থাপত্যের ইতিহাসে মূলত ধর্মীয়, প্রশাসনিক বা নান্দনিকতার উদ্দেশ্যে নির্মিত স্থাপত্যগুলির প্রতিষ্ঠাকাল ও প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যগুলি চিহ্নিত করা হয়।
২. ইতিহাস নির্মাণ : স্থাপত্যগুলির মাধ্যমে অতীত ও বর্তমান যুক্ত থাকে বলে স্থাপত্যগুলির প্রতিষ্ঠাকাল থেকে বর্তমানকাল পর্যন্ত সময়ের ইতিহাস রচনায় এগুলির ভূমিকা তুলে ধরা হয়।
৩. স্থাপত্য রীতি : প্রতিটি পৃথক স্থাপত্য রীতির বৈশিষ্ট্য, বিবর্তন ও তার ধারাবাহিকতা তুলে ধরা এই ইতিহাসের বিশেষ লক্ষণ। এ প্রসঙ্গে ইউরােপের স্থাপত্যে ডােরীয় রীতি, গথিক রীতি, রােমান ও ভিক্টোরীয় রীতির কথা বলা যায়।
৪. জাতীয় গর্ব : বিভিন্ন দেশের সেরা স্থাপত্যগুলি কীভাবে সেই দেশের মর্যাদা বৃদ্ধি করে বা জাতীয় আন্দোলনে উৎসাহের সার করে তা তুলে ধরাও এই ইতিহাসের বৈশিষ্ট্য।
উপসংহার : স্থাপত্যের ইতিহাসচর্চার সঙ্গে সঙ্গে অর্থনীতি, রাজনীতি ও সংস্কৃতির ইতিহাসও জড়িয়ে থাকায় স্থাপত্য ইতিহাস সামগ্রিক ইতিহাসের একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
১৯) স্থানীয় ইতিহাসচর্চার বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ করাে। অথবা, স্থানীয় ইতিহাসচর্চা সম্পর্কে টীকা লেখাে।
উত্তর:- ভূমিকা : আধুনিক ইতিহাসচর্চার বিশেষ দিক হল স্থানীয় ইতিহাস। স্থানীয় ইতিহাস বলতে বােঝায় ভৌগােলিকভাবে স্থানীয় প্রেক্ষিতে আঞ্চলিক সম্প্রদায় বা ব্যক্তি বা বিষয়কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ইতিহাস।
বিভিন্ন দিক : স্থানীয় ইতিহাসচর্চার বিভিন্ন দিককে এভাবে চিহ্নিত করা যায়—
১. স্থানীয় ইতিহাসের সূত্রপাত : উনিশ শতকের ইংল্যান্ডে প্রত্যন্ত এলাকাগুলাের বা শহরের ইতিহাস রচনার মাধ্যমে স্থানীয় ইতিহাস। লেখা শুরু হয়। পরবর্তীকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়াতেও এই ধরনের ইতিহাস রচনা শুরু হয়।
২. স্থানীয় বিষয় : এই ধরনের ইতিহাসচর্চায় দেশ বা ব্যাপক এলাকার পরিবর্তে ক্ষুদ্র এলাকাকে চিহ্নিত করে সেই স্থানের ইতিহাস অন্বেষণ করা হয়। এভাবে স্থানীয় ইতিহাসসমূহের সমন্বয়ে দেশের ইতিহাস গড়ে তােলার চেষ্টা করা হয়।
৩. মৌখিক পরম্পরা : স্থানীয় জনশ্রুতি, মিথ বা অতিকথা, উপকথা, মৌখিক পরম্পরাকে ভিত্তি করে রচিত স্থানীয় ইতিহাস অনেকক্ষেত্রেই অলিখিত থাকে এবং এজন্যই মৌখিক পরম্পরার উপর গুরুত্ব আরােপ করা হয়।
৪. সমাজের ক্ষুদ্র ইতিহাস : স্থানীয় ইতিহাস রচনাকালে স্থানীয় সমাজের ক্ষুদ্র সম্প্রদায় বা ব্যক্তি বা পরিবারের ইতিহাসকে তুলে ধরে এলাকার গুরুত্ব চিহ্নিত করা হয়। তাই এই ইতিহাস হল বৃহত্তর সমাজ-ইতিহাসের ক্ষুদ্র সংস্করণ।
২০) শহরের ইতিহাসচর্চার বিষয়টি উল্লেখ করে কলকাতার গুরুত্ব বিশ্লেষণ করাে।
উত্তর:- শহরের উদ্ভব, বিকাশ, বিস্তার ও অবক্ষয় সম্পর্কিত তথ্যের চর্চা হল শহরের ইতিহাস। এই ইতিহাসের দিকগুলি হল—
প্রথমত, শহরের বাসিন্দা ও তাদের সমাজবিন্যাস এবং তাদের কার্যকলাপসহ শহরের আর্থ-রাজনৈতিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক গুরুত্বকে চিহ্নিত করা।
দ্বিতীয়ত, ১৯২০-র দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শহরের ইতিহাসচর্চার সূচনা হয়; শহরের ইতিহাসচর্চার সঙ্গে যুক্ত ঐতিহাসিকরা হলেন—স্টিফেন থার্নস্টর্ম, এডুইন বারােজ, মাইক ওয়ালেস, কলিন জোনস, রােনাল্ড টেলর, ক্রিস্টিন ডবিন, নারায়ণী গুপ্ত, লক্ষ্মী সুব্রম্ভণ্যম।
কলকাতার গুরুত্ব : ভারতের অন্য শহরগুলির তুলনায় কলকাতা তরুণ হলেও শহরের ইতিহাসচর্চায় কলকাতার গুরুত্ব অনেক, যেমন—
১. কলকাতার প্রতিষ্ঠা ও ঔপনিবেশিক শহর : কলকাতা শহরটি যে জোব চার্নক-এর তৈরি নয়, সে-কথা অনেক দিন আগেই প্রমাণিত হয়ে গেছে। তারপর পলাশীর যুদ্ধের মাধ্যমে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এই বাংলার এই শহরকে কেন্দ্র করে ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠা করে।
২. জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পীঠস্থান : ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা থেকে রাজধানী দিল্লিতে স্থানান্তরিত হলে কলকাতার গুরুত্ব কমে যায় ঠিকই, কিন্তু ভারতের রাজনৈতিক ও স্বাধীনতা আন্দোলনের নতুন কর্মকেন্দ্র হয়ে ওঠে কলকাতা। বলা বাহুল্য, ভারতে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরাট একটি অধ্যায়ের সাক্ষী কলকাতাই।
৩. সাংস্কৃতিক কেন্দ্র : বাণিজ্যিক না হােক, কলকাতা আজও দেশের সাংস্কৃতিক রাজধানী তাে বটেই। অল্প কথায়, কলকাতা শহর আধুনিক ইতিহাসচর্চায় নিঃসন্দেহে আলাদা মনোেযােগ দাবি করে।
২১) শহরের ইতিহাসচর্চার বৈশিষ্ট্যগুলি কীভাবে বিশ্লেষণ করবে ?
উত্তর :- ভূমিকা :১৯২০-র দশক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শহর-ইতিহাসচর্চা শুরু হয় এবং ১৯৬০-র দশক থেকে এই ইতিহাসচর্চায় জোয়ার দেখা দেয়।
শহরের ইতিহাসের বৈশিষ্ট্য : শহর ইতিহাসচর্চার বৈশিষ্ট্যগুলি হল -
১. শহরের উদ্ভব ও অবক্ষয় : কেন ও কীভাবে শহরের উদ্ভব ঘটে। এবং শহরের প্রসার ও তার অবক্ষয়কে চিহ্নিত করাই হল শহরের ইতিহাসচর্চার প্রধানতম দিক। তাই এই ধরনের ইতিহাসচর্চায় গড়ে ওঠা শহর বা অবক্ষয়প্রাপ্ত শহর বা মহানগরকে গবেষণার জন্য বেছে নেওয়া হয়।
২. শহর-সংস্কৃতি : শহরের বাসিন্দা ও তাদের বিন্যাস, শহরে অভিপ্রয়াণের ইতিহাস এবং তাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকলাপকে চিহ্নিত করে শহরের বিবর্তনকে চিহ্নিত করা শহর ইতিহাসচর্চার বিশেষ বৈশিষ্ট্য।
৩. শহরের ভূগােল : শহর-ইতিহাসচর্চায় শহরের ভৌগােলিক অবস্থান এবং সামরিক ও বাণিজ্যিক গুরুত্বকে চিহ্নিত করা হয়। এগুলি শহরের ইতিহাস ও নাগরিক জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত।
৪. শহরের স্থাপত্য : শহরে নাগরিকদের বাসস্থান, প্রশাসনিক ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র নির্মাণ, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণ, খেলা ও অবসর বিনােদনের জন্য স্টেডিয়াম ও পার্ক নির্মাণকে কেন্দ্র করে স্থাপত্য নির্মাণ করা হয়। তাই শহরের ইতিহাসের সঙ্গে থাপত্য-ইতিহাসও জড়িয়ে পড়ে।
উপসংহার : শহরের ইতিহাস শুধুমাত্র শহরের উদ্ভব ও অবক্ষয়কে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয় না, বরং তার সঙ্গে সামাজিক, আর্থ-রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসও ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত থাকে।
২২) পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনের সঙ্গে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সম্পর্ক কী ?
উত্তর:- উনিশ শতকের উপজাতীয় কৃষক জীবন বিভিন্ন কারণে অশান্ত হয়ে ওঠে। ঐতিহাসিক রামচন্দ্র গুহ এই পরিস্থিতিকে অশান্ত অরণ্যজীবন’ বলে অভিহিত করেছেন।
পরিবেশ ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ
১. উক্তি গবেষণা : অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা ও মাদ্রাজ দখলের পরে এই দুই অঞ্চলের উদ্ভিদ নিয়ে গবেষণা শুরু করেছিল এবং বােটানিক্যাল গার্ডেন প্রতিষ্ঠাকরেছিল। এই গবেষণার পশ্চাতে ভারতের পরিবেশ রক্ষার চাইতে অধিক গুরুত্ব পেয়েছিল ইংরেজ কোম্পানির বাণিজ্যিক, সামরিক ও বৈজ্ঞানিক স্বার্থ।
২. বনজ সম্পদ ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা : এই সময় উপজাতীয় ও কৃষকদের বনজ সম্পদ ব্যবহারের প্রথাগত অধিকারের বিরুদ্ধে সরকারি বিধিনিষেধের হুমকি দেওয়া হয়। কারণ,
প্রথমত ১৮০৬ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডে ওক কাঠের অভাব হলে এবং রাজকীয় নৌবাহিনীর জন্য ভারতীয় ওক কাঠের দরকার পড়লে ভারতের বিশাল বনজসম্পদের ওপর ব্রিটিশদের নজর পড়ে।
দ্বিতীয়ত, উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে (১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে) ভারতে রেলপথ পাতা শুরু হলে, তার জন্য দরকার পড়ে প্রচুর। কাঠের তক্তা বা ‘স্লিপার'।
এইসব প্রয়ােজনের দিকে তাকিয়ে ঔপনিবেশিক সরকার ভারতের বনজসম্পদ আহরণে আগ্রহী হয় এবং ঔপনিবেশিক অরণ্য আইন চালু করে। এর ফলে আদিবাসী সহ ভারতের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ অরণ্যের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। তাই পরিবেশের ভারসাম্য ও বনচারী উপজাতির অধিকারের স্বার্থে শুরু হয় আন্দোলন।
২৩) পরিবেশের ইতিহাসচর্চার গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে আলােচনা করাে।
উত্তর:- পরিবেশের অর্থাৎ, প্রকৃতি জগতের সঙ্গে মানবসমাজের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ইতিহাসই হল পরিবেশের ইতিহাস।
ইতিহাসের বিভিন্ন দিকগুলি হল—
প্রথমত, পৃথিবী সৃষ্টির কাল থেকে মানুষের আবির্ভাব এবং পশুশিকারি জীবন থেকে আধুনিক মানবসভ্যতার উদ্ভবের পিছনে পরিবেশের ভূমিকা ও অবদানকে চিহ্নিত করাই এই ইতিহাসের মূল বৈশিষ্ট্য।
দ্বিতীয়ত, ১৯৬০ ও ১৯৭০-এর দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পরিবেশ সংক্রান্ত আলােচনা থেকেই পরিবেশের ইতিহাসচর্চা শুরু হয়েছে; এই ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত গবেষকরা হলেন—র্যাচেল কারসন, ডেভিড আরনল্ড, রামচন্দ্র গুহ, মাধব গ্যাডগিল, রিচার্ড গ্রোভ, স্যামুয়েল পি. হাইজ, আলফ্রেড ডব্লিউ ক্রুস।
পরিবেশ আন্দোলন : পরিবেশ ইতিহাসচর্চার একটি দিক হল পরিবেশ সংক্রান্ত আন্দোলন ও পরিবেশ সংরক্ষণ। পাশ্চাত্য দেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গড়ে ওঠা এইসব আন্দোলনের মধ্যে ভারতের ‘তেহেরি গাড়ােয়াল’, ‘চিপকো আন্দোলন’, নর্মদা আন্দোলনের কথা বলা যায়।
পরিবেশ আন্দোলনের গুরুত্ব : পরিবেশের ইতিহাসচর্চার গুরুত্বগুলি হল -
প্রথমত, মানবসভ্যতার অগ্রগতিতে পরিবেশের ভূমিকা চিহ্নিত করে পরিবেশ সচেতনতা ও পরিবেশ রক্ষার ব্যবস্থা করা।
দ্বিতীয়ত, পরিবেশ সংকট ও তার প্রকৃতি, পরিবেশ বিপর্যয় ও তার ভয়াবহতা, বাস্তুতন্ত্র ও বাস্তুতন্ত্র সংরক্ষণ, অরণ্য ও অরণ্যপ্রাণী সংরক্ষণ সম্পর্কে সম্যক ধারণা ও তার প্রয়ােগের ব্যবস্থা করা।
তৃতীয়ত, পরিবেশের ইতিহাসের সঙ্গে অন্যান্য ইতিহাসের যােগসূত্র নির্ধারণ করা।
২৪. বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও চিকিৎসাবিদ্যার ইতিহাসচর্চার বৈশিষ্ট্যগুলি বিশ্লেষণ করাে।
উত্তর:- ভূমিকা : বিজ্ঞান ও বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের বিকাশ, প্রযুক্তির উদ্ভব ও তার অগ্রগতি এবং চিকিৎসাবিদ্যার অগ্রগতিই বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও চিকিৎসাবিদ্যার ইতিহাসচর্চা নামে পরিচিত।
বৈশিষ্ট্য : বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও চিকিৎসাবিদ্যার ইতিহাসচর্চার বৈশিষ্ট্যগুলি হল—
১. জ্ঞানচর্চার ইতিহাস : প্রকৃতি ও মানব শারীরতত্ত্ব সম্পর্কে পর্যবেক্ষণ, গবেষণা ও তার ব্যাখ্যার ফলেই তত্ত্বগত ও ব্যাবহারিক জ্ঞানের উন্মেষ ঘটেছে বলে এই ইতিহাস হল বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও চিকিৎসাবিদ্যা সম্পর্কিত জ্ঞানচর্চার ইতিহাস।
২. অগ্রগতি উপস্থাপন : এই ধরনের ইতিহাসচর্চায় ইউরােপের রেনেসাঁস পর্বের পরবর্তীকাল থেকে বিংশ শতক পর্যন্ত সময়ের বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, শারীরজ্ঞান ও চিকিৎসাবিদ্যার অগ্রগতি পরিমাপ করা হয়।
৩. মানবসভ্যতায় প্রভাব : বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও চিকিৎসাবিদ্যা কীভাবে মানবসমাজ ও সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করেছে এবং দেশের অর্থনৈতিক, সামরিক ও চিকিৎসার ক্ষেত্রকে কীভাবে প্রভাবিত করেছে তা আলােচনা করাই এই ইতিহাসের উদ্দেশ্য।
৪. মানবসভ্যতা থেকে যন্ত্রসভ্যতা : মানুষ তার বুদ্ধি ও শ্রমকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন ধরনের অস্ত্রশস্ত্র, যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তির উন্নতি ঘটায়। প্রযুক্তির অগ্রগতিকে চিহ্নিত করে মানবসভ্যতার যন্ত্রসভ্যতায় উত্তরণকে ব্যাখ্যা করা এই ইতিহাসের বিশেষ বৈশিষ্ট্য।
উপসংহার : বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও চিকিৎসাবিদ্যার ইতিহাসচর্চা আধুনিক ইতিহাসচর্চার এক বিশেষ অঙ্গরূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছে। এমনকি সাধারণ ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রেও বিজ্ঞান-প্রযুক্তির ব্যবহার বাধ্যতামূলক।
২৫) স্বাধীনতাপূর্ব ও স্বাধীনােত্তর ভারতবর্ষে চিকিৎসাবিদ্যার অগ্রগতি কেমন হয়?
উত্তর :- ভূমিকা : ঔপনিবেশিক ভারত ও স্বাধীনােত্তর ভারতে চিকিৎসাবিদ্যার বিকাশ ছিল গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এই দুই পর্বের চিকিৎসাবিদ্যার অগ্রগতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়—
১. কলকাতা মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা : ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে ভারতে পাশ্চাত্য চিকিৎসাবিদ্যা শিক্ষার প্রসারের জন্য কলকাতা মেডিকেল কলেজ স্থাপিত হয়। কালক্রমে এখানে এম বি বি এস ডিগ্রির পাশাপাশি এল এম এস, এম বি এবং এম ডি পঠনপাঠনের ব্যবস্থা করা হয়।
২. অন্যান্য মেডিকেল কলেজ : কলকাতা মেডিকেল কলেজের পাশাপাশি বােম্বাইয়ে গ্রান্ট মেডিকেল কলেজ (১৮৪৫ খ্রি.), লাহাের মেডিকেল কলেজ (১৮৬০ খ্রি.), লক্ষ্ণৌতে কিং জর্জ কলেজ (১৯০৬ খ্রি.) প্রতিষ্ঠিত হয়।
৩. পেশাদারি চিকিৎসা : ডাঃ নীলরতন সরকার, ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়, ডাঃ সুন্দরীমােহন দাস প্রমুখ চিকিৎসকগণ অসাধারণ পেশাদারি দক্ষতা দেখান।
৪. স্বাধীনােত্তর ভারতে চিকিৎসাবিদ্যা : স্বাধীনােত্তর ভারতে চিকিৎসাবিদ্যার যথেষ্ট অগ্রগতি ঘটে। পরিকাঠামাে ব্রিটিশদের হাতে তৈরি হলেও, ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে বিধানচন্দ্র রায়ের প্রচেষ্টায় কলকাতায় ভারতের প্রথম স্নাতকোত্তর চিকিৎসা বিদ্যায়তনের সূচনা হয়।
এ ছাড়া ভারতে চিকিৎসার ক্ষেত্রে কলকাতার চিত্তরঞ্জন ক্যানসার হাসপাতাল ও কুমুদশংকর রায় যক্ষ্মা হাসপাতাল, বােম্বাইয়ের টাটা ক্যানসার রিসার্চ ইন্সটিটিউট, দিল্লির অল ইন্ডিয়া ইন্সটিটিউট অফ মেডিকেল সায়েন্স প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখযােগ্য। সম্প্রতি ডাঃ সৌম্য স্বামীনাথন চিকিৎসাশাস্ত্রে দক্ষতার জন্য আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সংস্থার উপমহানির্দেশক হয়েছেন।
২৬) নারী ইতিহাসের চর্চার বৈশিষ্ট্য আলােচনা করাে। অথবা, নারী-ইতিহাসের ওপর একটি টীকা লেখাে।
উত্তর:- ভূমিকা : প্রচলিত ইতিহাসে নারীর ভূমিকা বা অধিকারের যথাযথ মূল্যায়নের প্রয়ােজনে নারীর গুরুত্বকে তুলে ধরার ইতিহাসচর্চাই হল নারী ইতিহাস।
বৈশিষ্ট্যসমূহ : নারী ইতিহাসের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যগুলি হল—
১. পুরুষকেন্দ্রিক ইতিহাস সংশােধন : সভ্যতার ইতিহাসে পুরুষদের পাশাপাশি নারীদের ভূমিকাও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি যুদ্ধ, প্রশাসন, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতিতে পুরুষদের ভূমিকাকে বা অবদানকে বেশি করে চিহ্নিত করেছে আর নারীরা উপেক্ষিত হয়েছে। তাই উপেক্ষিত নারীদের ইতিহাস উদ্ধারের কাজ হল এই ইতিহাসের বৈশিষ্ট্য। |
২. অধিকার ও সমতা প্রতিষ্ঠা : এই ইতিহাসচর্চার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল নারীর অধিকার এবং নারী-পুরুষ সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা। নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বপ্রথম লেখালেখি করেন ইংল্যান্ডের মেরি ওলস্টনস্ক্রাফ্ট এবং পরবর্তীকালে ফ্রান্সের সিমােন দ্য বােভােয়ার।
৩. নারীর অংশগ্রহণ : নারী-ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ দিক হল বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক জীবনে নারীর অংশগ্রহণ।
৪. সভ্যতার অগ্রগতির মাপকাঠি : কোনাে দেশের সভ্যতা সমাজে নারীর অবস্থান ও মর্যাদার ওপর সেই সভ্যতার উৎকর্ষ নির্ভর করে বলে নারী-ইতিহাসচর্চা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
উপসংহার : উপরােক্ত আলােচনা থেকে দেখা যায় যে নারী-ইতিহাসচর্চা হল এক ধরনের সংশােধনবাদী ইতিহাসচর্চা। তবে এই ইতিহাসচর্চার ফলে ইতিহাস বিকৃতির সম্ভাবনাও রয়েছে।
২৭) আধুনিক ভারতের ইতিহাসচর্চার উপাদানরূপে সরকারি নথিপত্রকে কীভাবে ব্যবহার করা হয় তা বিশ্লেষণ করাে। অথবা,ইতিহাসের উপাদান হিসেবে সরকারি নথিপত্রের সীমাবদ্ধতা লেখাে।
উত্তর:- ভূমিকা : আধুনিক ভারতের ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল সরকারি নথিপত্র। এগুলির মধ্যে উল্লেখযােগ্য হল বডােলাট ও ভারত-সচিবের দলিলপত্র, বড়ােলাটের নিম্নপদস্থ রাজকর্মচারীদের রিপাের্ট বা প্রতিবেদন ও চিঠিপত্র, পুলিশ ও গােয়েন্দা রিপাের্ট প্রভৃতি।
ব্যবহার পদ্ধতি : সরকারি নথিপত্রগুলি থেকে ভূমিরাজস্ব, বিদ্রোহ, সরকারের (আর্থিক, রাজনৈতিক প্রশাসনিক ও সাংস্কৃতিক) নীতির কথা এবং ভারতের রাজনৈতিক, আন্দোলনের কথা জানা গেলেও এইসব তথ্য সবসময় সত্যি নাও হতে পারে।
তাই এক্ষেত্রে কয়েকটি সতর্কতা নেওয়া প্রয়ােজন :
১. নিরপেক্ষ ব্যাখ্যা : ব্রিটিশ আমলে সরকারি নথিপত্রগুলির অধিকাংশই সাম্রাজ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে লেখা। হওয়ায়। উপনিবেশ-বিরােধী, জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ও কার্যকলাপ সম্পর্কে সেগুলিতে নেতিবাচক বর্ণনাই পাওয়া যায়। তাই এইসব নথিপত্রের নিরপেক্ষ ব্যাখ্যা প্রয়ােজন।
২. বেসরকারি তথ্যের সঙ্গে যাচাই : বেসরকারি নথি বা সাহিত্য বা আন্দোলনকারীদের জীবনস্মৃতি বা মুখের কথার মাধ্যমে সরকারি নথিপত্রগুলির বর্ণনা যাচাই করা প্রয়ােজন।
৩. সংবাদপত্রের সঙ্গে যাচাই : সংবাদপত্রের প্রতিবেদন বা রচনায় সমসাময়িক ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায়। তাই এগুলি থেকে সরকারি নথির তথ্য যাচাই করা উচিত।
8. নৈর্ব্যক্তিক মানসিকতা দ্বারা যাচাই : সরকারি নথিপত্র থেকে নিরপেক্ষ ইতিহাস গড়ে তুলতে হলে নথিপত্র ব্যবহারকারীকে নিরপেক্ষ ও নৈর্ব্যক্তিক হতে হবে।
২৮) 'স্মৃতিকথা’ কি ইতিহাসের নির্ভরযােগ্য উপাদান?
উত্তর:- স্মৃতিকথা : আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথা হল ব্যক্তির জীবন ও স্মৃতিমূলক সাহিত্য।
প্রথমত, এখানে লেখক তার জীবনে ঘটে যাওয়া প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষ ঘটনা এবং সমসাময়িক দেশকালের স্মৃতি রােমন্থন করে গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেন।
দ্বিতীয়ত, এ প্রসঙ্গে বিপিনচন্দ্র পালের ‘সত্তর বছর’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'জীবনস্মৃতি’ও সরলাদেবী চৌধুরানির ‘জীবনের ঝরাপাতা নামক আত্মজীবনীর কথা বলা যায়।
স্মৃতিকথার ব্যবহার : বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে ইতিহাসচর্চায় স্মৃতিকথা বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। যেমন—
১. নাৎসি অত্যাচারের ইতিহাস : জার্মানিতে হিটলারের নাৎসি অত্যাচারের তথ্য বেশিরভাগই সংগৃহীত হয়েছে স্মৃতি-নির্ভর রচনা থেকে।
২. ভারতের দেশভাগের ইতিহাস : ভারতবর্ষের মানুষের দেশভাগের অভিজ্ঞতার অধিকাংশ ইতিহাস বিবৃত রয়েছে বিভিন্ন গ্রন্থে, প্রবন্ধে, সাংবাদিক রচনায়।
সীমাবদ্ধতা : স্মৃতিকে ইতিহাসের মূল্যবান উপাদান হিসেবে যদি ধরাও যায়, তবুও স্মৃতিকথাকে ইতিহাসে ব্যবহার করার অনেক সীমাবদ্ধতা আছে, যেমন—
১. নির্ভরযােগ্যতায় প্রশ্ন : স্মৃতিকথা থেকে উঠে আসা তথ্য কতটা ঐতিহাসিকভাবে সত্য বা নির্ভরযােগ্য, সে প্রশ্ন থেকেই যায়। স্মৃতিকথা সাধারণত বার্ধক্য বা প্রৌঢ়ত্বের ফসল।
২. অস্পষ্টতা : লেখকের স্মৃতি, লেখককে বিভ্রান্ত বা প্রতারিত করতেই পারে। স্মৃতি সেখানে স্পষ্ট নাও হতে পারে।
৩. ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি : স্মৃতিকথা মানেই ইতিহাসের উপাদান নয়, কারণ এগুলিতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গির তফলন পড়ে যা ইতিহাসের উপাদান হয়ে উঠতে বাধা দেয়।
২৯. বিপিনচন্দ্র পালের আত্মচরিত ‘সত্তর বৎসর’ কীভাবে ভারতের আধুনিক ইতিহাসের উপাদান হয়ে উঠেছে তা বিশ্লেষণ করাে। অথবা, আধুনিক ভারতের ইতিহাসের উপাদান হিসেবে বিপিনচন্দ্র পালের ‘সত্তর বৎসর’ নামক আত্মজীবনী গ্রন্থের গুরুত্ব কী?
উত্তর:- ভূমিকা : ভারতের জাতীয়তাবাদী ও চরমপন্থী নেতা বিপিনচন্দ্র পালের আত্মজীবনী ‘সত্তর বৎসর’-এ ১৮৫৮-১৮৮০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালের পরিস্থিতি বর্ণিত হয়েছে। ফলে এটি আধুনিক ভারতের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ গৌণ উপাদান।
উপাদানের বিভিন্ন দিক : ‘সত্তর বৎসর’ থেকে ইতিহাসের যে দিকগুলাে জানা যায় তা হল -
১. গ্রাম ও শহরের কথা : এই গ্রন্থ থেকে বিপিনচন্দ্র পালের বংশ ও পারিবারিক ইতিহাস, বাখরগঞ্জ, কেঁচুগঞ্জ, শ্রীহট্ট, হবিগঞ্জ-এর
মতাে গ্রামের পাশাপাশি তৎকালীন কলকাতা শহরের ইতিহাসও জানা যায়।
২. সংস্কৃতি : সত্তর বৎসর থেকে গ্রামীণ সংস্কৃতি অর্থাৎ দোল-দুর্গোৎসব, যাত্রাগান ও পুরাণপাঠ, বিবাহ প্রথার পাশাপাশি কলকাতার তৎকালীন সংস্কৃতি, খাদ্যাভ্যাস ও বিধিনিষেধ, মদ্যপান ও মদ্যপান নিবারণী সমিতির কথাও জানা যায়।
৩. ব্রাহ্মসমাজের রাজনৈতিক আদর্শ : তিনি দেখিয়েছেন ইংরেজি শিক্ষিত বাঙালিরা নতুন সামাজিক আদর্শের সন্ধান পেয়েছিল। তৎকালীন ব্রাহ্রসমাজও এই শিক্ষিত বাঙালিদের মধ্যে স্বাধীনতার আদর্শের সঞ্চার করেছিল।
৪. ভারতসভা ও হিন্দুমেলা : সত্তর বৎসর’ থেকে আনন্দমােহন বসু ও সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়-এর নেতৃত্বে ছাত্রসভা বা স্টুডেন্টস অ্যাসােসিয়েশন’ ও ‘ভারতসভা গঠনের কথা এবং নবগােপাল মিত্র ও তার প্রতিষ্ঠিত ‘ হিন্দুমেলা’ নামক জাতীয়তাবাদী প্রতিষ্ঠানের কথাও জানা যায়।
উপসংহার : বিপিনচন্দ্র পালই প্রথম ব্যক্তিত্ব যিনি তাঁর আত্মজীবনীতে ‘দেশকথা’কে তুলে ধরেছেন। তবে তার এই দেশকথাতে বেশ কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে।
৩০. আধুনিক ভারতের ইতিহাসের উপাদানরূপে জীবনস্মৃতি’র গুরুত্ব বিশ্লেষণ করাে। অথবা, ইতিহাসের উপাদান হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘জীবনস্মৃতি' গুরুত্বপূর্ণ কেন ?
উত্তর:- ভূমিকা : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচিত ‘জীবনস্মৃতি' নামক আত্মজীবনীটি একটু ভিন্ন ধরনের, কারণ এই গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ তার আত্মগঠনের প্রক্রিয়া বর্ণনা করেছেন। তাই আধুনিক ভারতের ব্যক্তি-ইতিহাস রচনার উপাদানরূপে এই গ্রন্থটি অধিক গুরুত্বপূর্ণ। জীবনস্মৃতির গুরুত্ব’ : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচিত ‘জীবনস্মৃতি'র গুরুত্বগুলি হল—
১. বাল্যকথা : এই গ্রন্থ থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছােটোবেলার ‘শিক্ষারম্ভ’, ওরিয়েন্টাল সেমিনারির শিক্ষাব্যবস্থা এবং নর্মাল স্কুল ও সেখানকার শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে জানা যায়।
২. ধর্মীয় পরিবেশ : রবীন্দ্রনাথের পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একজন ব্রাত্ম নেতা; রবীন্দ্রনাথ ব্রাত্মধর্মে দীক্ষিত হন। তার এই রচনার মাধ্যমে গায়ত্ৰীমন্ত্র ও ‘ ব্রসংগীত’-এর কথা এবং ব্রাত্মধর্মের আত্মসমালােচনাও জানা যায়।
৩. ঠাকুরবাড়ির পরিমণ্ডল : জীবনস্মৃতি’ থেকে ঠাকুর পরিবারের পারিবারিক ঐতিহ্য, সাহিত্য, কাব্য-নাটক ও চিত্রকলার চর্চার কথা যেমন জানা যায়, তেমনই, এর পাশাপাশি জাতীয়তাবাদের বিকাশে ঠাকুরবাড়ির অবদানও পরিলক্ষিত হয়।
৪. স্বাদেশিকতা : রবীন্দ্রনাথ তার এই স্মৃতিকথায় জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্যোগে এবং রাজনারায়ণ বসুর সভাপতিত্বে পরিচালিত একটি স্বাদেশিকতা সভার কথা বলেছেন। এর পাশাপাশি ঠাকুরবাড়ির সাহায্যে নবগােপাল মিত্রের ‘হিন্দুমেলা’র প্রতিষ্ঠা হয়েছিল বলেও তিনি অভিমত প্রকাশ করেন।
উপসংহার : জীবনস্মৃতি ছিল উনিশ শতকের শেষ তিরিশ বছরের বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতির এক অনবদ্য ভাষ্য।
৩১) 'জীবনের ঝরাপাতা’ নামক আত্মজীবনী আধুনিক ভারতের ইতিহাসের উপাদানরূপে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা বিশ্লেষণ করাে।
উত্তর:- ভূমিকা : সরলাদেবী চৌধুরানি তার (১৮৭২-১৯৪৫ খ্রি.) আত্মজীবনী জীবনের ঝরাপাতা’-তে ব্যক্তিজীবনের কাহিনির পাশাপাশি জাতীয় জীবনের কথাও জানা যায়। তাই আত্মজীবনীটি ভারতের আধুনিক ইতিহাসের এক মূল্যবান সূত্র।
উপাদানরূপে গুরুত্ব : ইতিহাসের উপাদানরূপে যে-সমস্ত কারণে এই আত্মজীবনীটি গুরুত্বপূর্ণ তা হল—
১. ঠাকুর পরিবারের ইতিহাস : উনিশ শতকের বাংলার শীর্ষস্থানীয় মহিলা সাহিত্যিক স্বর্ণকুমারী দেবীর কন্যা এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাগনি সরলাদেবী তাঁর রচনার মাধ্যমে ঠাকুর পরিবারের ঐতিহ্যের নানান কথা প্রকাশ করেছেন।
২. রাজনৈতিক ইতিহাস : এই বই থেকে উনিশ শতকের শেষদিকের চরমপন্থী জাতীয়তাবাদের সঙ্গে জড়িত দুই তাত্ত্বিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও স্বামী বিবেকানন্দের কথা যেমন জানা যায়, আবার তেমনই, বঙ্গভঙ্গ বিরােধী আন্দোলন ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভূমিকা এবং সরলাদেবীর স্বদেশি ভাবধারা প্রচারের কথাও রয়েছে এই আত্মজীবনীতে।
৩. সামাজিক ইতিহাস : এই বইয়ে অভিজাত পরিবারের কায়দাকানুন, নারীশিক্ষা, বাঙালি সংস্কৃতি ও সাহেবি সংস্কৃতি আলােচিত হয়েছে।
উপসংহার : তবে ‘জীবনের ঝরাপাতা'র কয়েকটি সীমাবদ্ধতা ছিল এবং একারণেই তা পুরােপুরি নির্ভরযােগ্য নয়। তাই এই গ্রন্থ থেকে প্রাপ্ত তথ্যকে সমসাময়িক অন্যান্য নথিপত্র থেকে প্রাপ্ত। তথ্যের দ্বারা যাচাই করা প্রয়ােজন।
৩২) ইন্দিরা গান্ধিকে লেখা জওহরলাল নেহরুর চিঠি (Letters from a Father to His Daughter) থেকে কীভাবে আধুনিক ভারতের ইতিহাসের উপাদান পাওয়া যায় ?
উত্তর:- ভূমিকা : আধুনিক ভারতের ইতিহাসের অন্যতম উপাদান হল চিঠিপত্র এবং এগুলির মধ্যে উল্লেখযােগ্য হল ইন্দিরা গান্ধিকে লেখা জওহরলাল নেহরুর চিঠি (Letters From a Father to His Daughter) ।
ইতিহাসের উপাদান : প্রবাদপ্রতিম জাতীয় নেতা জওহরলাল। নেহরুর লেখা চিঠিগুলি থেকে আধুনিক ভারতের ইতিহাসের যে সমস্ত উপাদান পাওয়া যায় সেগুলি হল—
১. চিঠিপত্র সেন্সর : গ্রন্থটির ভূমিকা থেকে জওহরলাল নেহরুর স্বাধীনতা সংগ্রাম ও কারাবরণের কথা ছাড়াও জানা যায়, সেসময় কারাগারে জেলবন্দির ঘন ঘন চিঠি লেখা যেত না।
২. অর্থনৈতিক দুর্দশা : জওহরলাল নেহরুর চিঠিপত্র থেকে ভারতের অর্থনৈতিক বৈষম্য, ধনী ঘরে উদ্বৃত্ত খাদ্য ও গরিবদের মধ্যে খাদ্যসংকটের কথা জানা যায়। তিনি অর্থনৈতিক বৈষম্যের দূরীকরণে ‘খদ্দর’ কিনে পরার কথা প্রচার করেন এবং এভাবে গরিব তাঁতিদের অর্থনৈতিক দিক দিয়ে উন্নত করার কথা বলেন।
৪. দেশীয় রাজ্যগুলির পরিস্থিতি : জওহরলাল নেহরুর চিঠিপত্র থেকে ভারতীয় প্রজাদের অর্থে দেশীয় রাজাদের বিলাসব্যসন ও শৌখিন গাড়িচড়ার কথা যেমন জানা যায়, তেমনি এই সমস্ত প্রজাদের অন্নকষ্ট, শিক্ষার অভাব ও চিকিৎসার অভাবের কথাও জানা যায়।
উপসংহার : জওহরলাল নেহরুর অন্যবদ্য চিঠিপত্রগুলির সাহিত্যিক মূল্য অপরিসীম। এ ছাড়া ঔপনিবেশিক শাসনে ভারত ও ভারতবাসীর বেদনাদায়ক পরিস্থিতি চিঠিপত্রের মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে।
৩৩) 'বঙ্গদর্শন’ নামক সাময়িকপত্র থেকে কীভাবে ভারতের ইতিহাসের উপাদান পাওয়া যায়? অথবা, ঐতিহাসিক উপাদানরূপে বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার মূল্যায়ন করাে।
উত্তর:- ভূমিকা : বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রকাশিত ‘বঙ্গদর্শন'-এ সাহিত্য রচনার পাশাপাশি ইতিহাস, পুরাতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব, ধর্মতত্ত্ব, বিজ্ঞান ও কৃষিতত্ত্ব আলােচনা, গ্রন্থ আলােচনা ও বাঙালির জীবনচর্চাও প্রকাশিত হত। তাই বঙ্গদর্শন’ থেকে প্রাপ্ত উপাদানকে ভারত ইতিহাসের উপাদান রূপে ব্যবহার করা যেতে পারে। যেমন—
১. চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত : বঙ্কিমচন্দ্রের মতে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ওপর আধুনিক বঙ্গসমাজ নির্মিত হয়েছে। 'বঙ্গদর্শন’-এর এরূপ মতামত ও আলােচনা ‘ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ আলােচনাকালে
উপাদানরূপে ব্যবহার করা যায়।
২. স্বার্থ সংঘাত : বঙ্গদর্শন’ থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ব্রিটিশ শাসনকালে ইংরেজি শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও এঁরা স্বার্থ সম্পর্কে উদাসীন থাকায় কৃষক শ্রেণির সঙ্গে শিক্ষিত মানুষের সামাজিক সংঘাত শুরু হয়।
৩. কৃষক স্বার্থ সংরক্ষণ : চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ও জমিদারি প্রথার কারণে কৃষক-স্বার্থ নষ্ট হলে ‘বঙ্গদর্শন’-এ কৃষক স্বার্থ সংরক্ষণের কথা প্রচার করা হয়। স্বাভাবিক কারণেই বঙ্গদেশের কৃষক অসন্তোষের ব্যাখ্যাকালে 'বঙ্গদর্শন' থেকে প্রাপ্ত তথ্য খুবই প্রাসঙ্গিক।
৪. মূল্যায়ণ : অনেকে বঙ্কিমচন্দ্র সম্পাদিত বঙ্গদর্শনে প্রকাশিত লেখার মধ্যে স্ববিরােধিতা দেখেছেন। কিন্তু এই বক্তব্য অমূলক। বঙ্কিমচন্দ্র প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য জ্ঞানচর্চায় পারদর্শী ছিলেন। তার পত্রিকা বাংলায় মানসিক জাগরণ সৃষ্টি করে। বিপিনচন্দ্র পাল বঙ্গদর্শনের যুগ’ বলে ১৮৭০-এর দশককে চিহ্নিত করেছেন।
৩৪) আধুনিক ভারতের ইতিহাসচর্চায় ফোটোগ্রাফের ব্যবহার কীভাবে করা হয় সে সম্পর্কে বিশ্লেষণ করাে।
উত্তর :- ভূমিকা : ১৮৫০-র দশকে ভারতে ফোটোগ্রাফি বা ক্যামেরায় ছবি তােলা শুরু হলে আধুনিক ভারতের ইতিহাসচর্চায় ‘ফোটোগ্রাফের ব্যবহার’ এক ধরনের নতুন ঐতিহাসিক উপাদান হয়ে ওঠে।
উপাদান : ফোটোগ্রাফি আলােকচিত্র থেকে ভারতের ইতিহাসের যে-সমস্ত উপাদান পাওয়া যায় সেগুলি হল—
১. স্থাপত্য ও প্রত্নক্ষেত্র সংরক্ষণ : ভারতে ফোটোগ্রাফির ব্যবহার শুরু হলে ভারতের স্থাপত্য ও প্রত্নক্ষেত্রগুলিকে ফোটোগ্রাফির মাধ্যমে সংরক্ষণের নির্দেশ দেওয়া হয় এবং সংরক্ষিত প্রত্নক্ষেত্রগুলির ফোটোগ্রাফি সংরক্ষণ ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হয়ে ওঠে।
২. ১৮৫৭-র বিদ্রোহ : উনিশ শতকে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকালের বিভিন্ন মুহূর্তকে ধরে রাখতে ফোটোগ্রাফির সাহায্য নেওয়া হয়। কলকাতা, বােম্বাই, লক্ষ্ণৌ প্রভৃতি স্থানের বিদ্রোহের ছবি এই বিদ্রোহের গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক উপাদান।
৩. রাজকীয় অনুষ্ঠানের ছবি : উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ‘দিল্লি দরবার’, কলকাতায় ইংল্যান্ডের রাজপরিবার সদস্যদের আগমন বা বিভিন্ন ভাইসরয়ের কার্যগ্রহণের দিন। অবসরগ্রহণের দিন বা বিভিন্ন ঘটনার ছবি তুলে রাখা হয়, যার মাধ্যমে ভারতে ব্রিটিশ প্রশাসন ও ইংল্যান্ডের রাজপরিবারের সঙ্গে ভারতের যােগসূত্র ফুটে ওঠে।
উপসংহার : ইতিহাসের উপাদানরূপে ফোটোগ্রাফি এক মূল্যবান আকরসূত্র। এগুলি বাস্তবসম্মত কেননা কোনাে ব্যক্তি ও ঘটনার আলােকচিত্রের সত্যতা অস্বীকার করা যায় না।
৩৫) ইতিহাসের তথ্য সংগ্রহে ইনটারনেট ব্যবহারের সুবিধা-অসুবিধা কী ?
উত্তর:- ভূমিকা : ইতিহাসচর্চার গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহের জন্য সাধারণ মহাফেজখানা, গ্রন্থাগার বা বিভাগীয় দপ্তর প্রভৃতি স্বীকৃত প্রতিষ্ঠানগুলির পাশাপাশি আজকাল ইনটারনেট (www) থেকেও ইতিহাসের তথ্য সংগ্রহ করা যায়।
ইনটারনেট ব্যবহারের সুবিধা : ইতিহাসের তথ্য সংগ্রহে ইনটারনেট ব্যবহারের সুবিধাগুলি হল—
১. তথ্যের সহজলভ্যতা : দেশবিদেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, গবেষণা কেন্দ্র, গ্রন্থাগার ও মহাফেজখানা, মিউজিয়াম প্রভৃতির সংগৃহীত নথিপত্র ও দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ ইনটারনেট-এ আপলােড-এর ফলে সহজেই তথ্য পাওয়া যায়।
২. সময় ও খরচ হ্রাস : ইতিপূর্বে তথ্য সংগ্রহ করতে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বা বিদেশে যেতে হত। কিন্তু এখন ঘরে বসে ইনটারনেটের মাধ্যমে তা খুব অল্প সময়ে ও অল্প খরচে পাওয়ার ফলে সময়ের অপচয় কমে ও গবেষণা খরচ হ্রাস পায়।
ইনটারনেট ব্যবহারের অসুবিধা : ইতিহাসের তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে ইনটারনেট ব্যবহারের কিছু অসুবিধাও রয়েছে, যেমন—
১. সত্যাসত্যের অনিশ্চয়তা : চাক্ষুষ নথিপত্র ঘেঁটে বা আকর গ্রন্থ পাঠ করে ইতিহাসের তথ্য সংগ্রহের সত্যতা সম্পর্কে যতটা নিশ্চিত হওয়া যায় ইনটারনেট থেকে প্রাপ্ত তথ্যে তা সম্ভব নয়।
২. তথ্য সূত্রের অভাব : ইনটারনেট থেকে পাওয়া তথ্য সংগ্রহের সময় তথ্যসূত্র তেমন না থাকার ফলে তথ্যের বিশ্বাসযােগ্যতাও থাকে না। আবার অনেক সময় ইনটারনেট-এ তথ্য সরবরাহে বিঘ্ন ঘটে; ফলে গবেষণার কাজ বাধাপ্রাপ্ত হয়।
উপসংহার : কোনাে একটি বিষয়ে অল্প সময়ে ইনটারনেট-এ চটজলদি প্রচুর পরিমাণ কাঙ্ক্ষিত তথ্য পাওয়া গেলেও পরে আকর গ্রন্থ বা নথিপত্র থেকে তথ্যগুলি মিলিয়ে নেওয়া উচিত। এর ফলে ইতিহাস বিকৃতি ঘটে না।
৩৬) সংবাদপত্র হিসেবে ‘সােমপ্রকাশের' ঐতিহাসিক গুরুত্ব কতটা ?
উত্তর:- সােমপ্রকাশ’ সংবাদপত্রটির প্রথম পরিকল্পনা করেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তার পরে পত্রিকাটির সম্পাদনার ভার নেন দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ। হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকায় ‘সােমপ্রকাশ’-কে প্রথম সারির একটি সংবাদপত্র বলে মন্তব্য করা হয়।
ইতিহাসের উপাদানরূপে : ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের পরিকল্পনায় সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ কর্তৃক প্রবর্তিত ‘সােমপ্রকাশ’ পত্রিকা (১৮৫৮ খ্রিঃ) আধুনিক ভারতের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। কারণ—
প্রথমত, এই পত্রিকায় সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান, সমাজতত্ত্ব, রাজনীতি প্রভৃতি বিভিন্নধর্মী বিষয় প্রকাশিত হত।
দ্বিতীয়ত, কৃষকদের স্বার্থরক্ষা ও চেতনার প্রসারে, নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে, বিধবাবিবাহ ও স্ত্রীশিক্ষা প্রসারের উদ্দেশ্যে লিখিত প্রবন্ধগুলি থেকে মূল্যবান উপাদান পাওয়া যায়।
তৃতীয়ত, এই পত্রিকায় ব্রিটিশ সরকারের জনবিরােধী নীতিগুলির সমালােচনার মাধ্যমে স্বাদেশিকতা প্রচার করা হত।
জনমানসে তীব্র প্রতিক্রিয়া : ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে লিটন দেশীয় সংবাদপত্র আইন জারি করলে ‘সােমপ্রকাশ’ সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু এর ফলে জনমানসে তীব্র ক্ষোভ সৃষ্টি হলে বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর অ্যাশনি ইডেনের প্রচেষ্টায় পত্রিকাটি আবার প্রকাশিত হয়।
উপসংহার : সহজ সরল ভাষা ও নির্ভীক সমালােচনার মাধ্যমে ‘সােমপ্রকাশ’ একটি আদর্শ সংবাদপত্রের দৃষ্টান্ত। ‘সােমপ্রকাশ’ যে জনমতের এক নিখুঁত দর্পণ হিসেবে কাজ করেছিল, তাতে কোনাে সন্দেহ নেই।
**************** সমাপ্ত ****************