Type Here to Get Search Results !

দশম শ্রেণি ইতিহাস দ্বিতীয় অধ্যায় ৪ নম্বরের প্রশ্ন ও উত্তর


মাধ্যমিক ইতিহাস দ্বিতীয় অধ্যায় ৪ নম্বরের প্রশ্ন ও উত্তর 
মাধ্যমিক ইতিহাস দ্বিতীয় অধ্যায় সংস্কার বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা ৪ নম্বরের প্রশ্ন ও উত্তর 
দশম শ্রেণি ইতিহাস দ্বিতীয় অধ্যায় ৪ নম্বরের প্রশ্ন ও উত্তর 
দশম শ্রেণি ইতিহাস দ্বিতীয় অধ্যায় সংস্কার বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা ৪ নম্বরের প্রশ্ন ও উত্তর 
মাধ্যমিক ইতিহাস দ্বিতীয় অধ্যায় বিশ্লেষণধর্মী প্রশ্ন ও উত্তর 


মাধ্যমিক / দশম শ্রেণি
ইতিহাস
দ্বিতীয় অধ্যায় :- সংস্কার : বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা
প্রতিটি প্রশ্নের মান : ৪


প্রশ্ন (১) ‘বামাবোধিনী পত্রিকা' থেকে উনিশ শতকের নারী সমাজ সম্পর্কে কী জানা যায় ?

উত্তর :- ভূমিকা : নারী উন্নয়নের উদ্দেশ্যে প্রকাশিত বামাবােধিনী রক্ষণশীল ও উদারনৈতিক উভয় গােষ্ঠীর লেখক-লেখিকা ধর্ম, নীতিবিজ্ঞান, ইতিহাস, গৃহচিকিৎসা, শিশুপালন, স্ত্রী-শিক্ষা প্রভৃতি বিষয়ে বিভিন্ন প্রবন্ধ রচনার মাধ্যমে নারী সমাজের উন্নয়নে সচেষ্ট হন।

নারী সমাজের অবস্থা : বামাবােধিনী পত্রিকা থেকে নারী সমাজের অবস্থা যেভাবে জানা যায় তা হল—

১. কুপ্রথার অস্তিত্ব : উনিশ শতকে নারীসমাজে বহুবিবাহ, বাল্যবিবাহ, পর্দাপ্রথার অস্তিত্ব লক্ষ করা যায়, সতীদাহপ্রথার চল থাকলেও বিধবাবিবাহ প্রথার প্রসার তেমন ঘটেনি।

২. সম্পত্তির অধিকারহীনতা : অর্থনৈতিক দিক দিয়ে নারীরা ছিল পরাধীন—বিবাহকালে ‘পিতৃদত্ত’ ও ‘ভ্রাতৃদত্ত’ যৌতুক এবং মাতৃদত্ত ‘স্ত্রীধন’ (মূলত অলংকার) ছাড়া সম্পত্তিতে নারীর অধিকার ছিল না। 

৩. শিক্ষার দাবি : নারী সুশিক্ষিতা হলেই সুগৃহিণী, সুপত্নী ও সুমাতা হওয়া সম্ভব এই যুক্তিতে উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে নারীসমাজে শিক্ষার প্রসার ঘটতে শুরু করে। বামাবােধিনী পত্রিকায় প্রকাশিত ‘কন্যার প্রতি মাতার উপদেশ’ বা ‘স্ত্রীলােকদিগের বিদ্যাশিক্ষার আবশ্যিকতা’ নামক রচনা থেকে এ কথা জানা যায়।

৪. নানা পেশায় নারী : বালিকা বিদ্যালয়, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে নারীদের একাংশ শিক্ষা গ্রহণ করে শিক্ষকতা বা ডাক্তারির পেশায় যােগ দেয়। উদাহরণরূপে চন্দ্রমুখী বসু, কুমুদিনী খাস্তগীর, কামিনী সেন এবং প্রথম মহিলা ডাক্তার কাদম্বিনী গাঙ্গুলির কথা বলা যায়। 

উপসংহার : বামাবােধিনী পত্রিকা থেকে প্রাপ্ত তৎকালীন নারীসমাজের চিত্র ছিল কলকাতা ও বাংলার বিভিন্ন শহরকেন্দ্রিক। 

প্রশ্ন (২) হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা থেকে বাংলার গ্রামীণ সমাজ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির অবস্থার কোন্ কোন্ দিক জানা যায় ? 

উত্তর:- ভূমিকা : উনিশ শতকের গ্রামীণ সমাজ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিভিন্ন দিকের বর্ণনা পাওয়া যায় হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ নামক সমকালীন ইংরেজি সংবাদপত্র থেকে। 

সমাজজীবন : বাংলার সমাজজীবনের উল্লেখযােগ্য দিকগুলি হল - 

১. কৃষিকাজ : গ্রামীণ সমাজে জমিদারদের উপস্থিতি থাকলেও কৃষকেরা আউশ ও আমন চাষের মাধ্যমে সারাবছরের খাদ্যশস্য জোগাড় করত। তবে নীলচাষের ব্যাপক প্রসার ঘটলে কৃষকেরা তাদের আউশ জমিতে নীলচাষ করতে বাধ্য হয়।

২. অলাভজনক নীলচাষ : অলাভজনক নীলচাষে কৃষকরা অসম্মতি জানালেও যে কৃষক একবার নীলকর সাহেবের কাছ থেকে নীলচাষের জন্য অগ্রিম অর্থ বা দাদন গ্রহণ করেছিল, তাদের নীলচাষ থেকে অব্যাহতি ছিল না। শেষ পর্যন্ত নীলচাষিরা নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল।

৩. আদিবাসী বিদ্রোহ : ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকার মতে, জোরপূর্বক  সাঁওতালদের বেগার খাটানাে, অতিরিক্ত খাজনার দাবি ও অর্থনৈতিক শােষণই ছিল সাঁওতাল বিদ্রোহের অন্যতম কারণ।

৪. মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের অবস্থা : উনিশ শতকে খাদ্যশস্যের বদলে অর্থকরী ফসল (যেমন—পাট, তুলা, তৈলবীজ, আখ) চাষ ও তা বিদেশে রপ্তানির কারণে কৃষিপণ্য ও খাদ্যশস্যের দাম বৃদ্ধি পেলে জনজীবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ছাড়া শিক্ষিত ব্যক্তির সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে বেকারত্ব বৃদ্ধি পায়।

উপসংহার : ‘ হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকায় যেভাবে বাংলার সমাজব্যবস্থা প্রতিফলিত হয়েছিল তা মূলত জাতীয়তাবাদীর দৃষ্টিভঙ্গিতে ফুটিয়ে তােলা সমাজচিত্র।

প্রশ্ন (৩) নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা কীভাবে জনমত গড়ে তােলে ? 

উত্তর:- ভূমিকা : গিরিশচন্দ্র ঘােষের সম্পাদনায় মধুসূদন রায় ইংরেজি সাপ্তাহিক সংবাদপত্ররূপে (অবশ্য ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দ থেকে দৈনিক) প্রকাশ করেন (৬ ফেব্রুয়ারি, ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দ)। এই পত্রিকার বিখ্যাত সম্পাদক হরিশচন্দ্র মুখােপাধ্যায় নীলকরদের অত্যাচার সম্পর্কে খবর প্রকাশ করে নীলচাষিদের বন্ধুতে পরিণত হয়েছিলেন।

জনমত গঠন : হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে যেভাবে জনমত গড়ে তােলে, তা হল - 

১. খবর প্রকাশ : ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকার সম্পাদক হরিশচন্দ্র মুখােপাধ্যায় এই কাগজে নীলকরদের অত্যাচার ও নীলচাষিদের দুর্দশা সম্পর্কে খবর প্রকাশ করে এ সম্পর্কে জনগণকে ওয়াকিবহাল করেন।

২. নীলচাষের স্বরূপ উদ্ঘাটন : নীলচাষের প্রসার ঘটলে কৃষকেরা তাদের আউশ চাষের জমিতে অলাভজনক নীলচাষ করতে বাধ্য হয়। তিনি নীলকরদের দাদন’ প্রথা ও তার মাধ্যমে নীলচাষিদের স্বাধীনতা হরণের কথাও তুলে ধরেন।

৩. নীলবিদ্রোহে ভূমিকা :নীল বিদ্রোহের সময় যেখানে ‘ভাস্কর', সংবাদ প্রভাকর' প্রভৃতি সংবাদপত্র দূর হতে নীলচাষিদের প্রতি সহানুভূতি জানিয়েছিল সেখানে ‘ হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ নীলবিদ্রোহের পুরােভাগে স্থান গ্রহণ করেছিল।

৪. বিদ্রোহীদের অর্থ ও আইনি সাহায্য : ইংরেজ পুলিশ কর্তৃক নীলবিদ্রোহ দমনকালে হরিশচন্দ্র বিদ্রোহীদের অর্থ ও আইনি সাহায্যের ব্যবস্থা করে নীলচাষিদের মুক্তিদাতায় পরিণত হন। 

উপসংহার : যােগেশচন্দ্র বাগলের মতে, নীলবিদ্রোহের সময় হরিশচন্দ্রের গৃহ অতিথিশালায় পরিণত হয়েছিল। শুধু তাই নয়, তিনি নীলবিদ্রোহকে সাফল্যমণ্ডিত করতে তাঁর সর্বস্ব ব্যয় করেছিলেন।

প্রশ্ন (৪) হুতােম প্যাঁচার নকশা’ গ্রন্থে উনিশ শতকের বাংলার কীরূপ সমাজচিত্র পাওয়া যায় ?  অথবা, হুতােম প্যাঁচার নকশা’-তে কালীপ্রসন্ন সিংহ কলকাতার কী সমাজচিত্র তুলে ধরেছেন ?

উত্তর:- ভূমিকা : কালীপ্রসন্ন সিংহ রচিত ‘হুতােম প্যাঁচার নক্‌শা’ নামক ব্যঙ্গাত্মক রচনা থেকে কলকাতার বিত্তবান নব্যবাবু সমাজের বিলাসব্যসন ও স্বার্থপরতার কথা-সহ সমাজ-সংস্কৃতির কথা জানা যায়।

সমাজ-সংস্কৃতি : কলকাতার সমাজ-সংস্কৃতির উল্লেখযােগ্য দিকগুলি হল—

১. সমাজবিন্যাস : ইংরেজ শাসন ও ব্যাবসাবাণিজ্যের সূত্র ধরে উনিশ শতকের সমাজবিন্যাসে পরিবর্তন আসে। ইংরেজ শাসনের আগে বাংলায় বড়াে বড়াে বংশের (কৃষচন্দ্র, রাজবল্লভ, মানসিংহ, নন্দকুমার, জগৎশেঠ) পতন ঘটে এবং নতুন জাতি ও বংশের (মল্লিক পরিবার, শীল পরিবার) উদ্ভবের কথা জানা যায়।

২. বাবু সংস্কৃতি : ব্যাবসাবাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ী এবং গ্রাম থেকে কলকাতায় চলে আসা জমিদাররা যে বিলাসবহুল এবং দেখনদারি সংস্কৃতির সূচনা করেছিল তা বাবু সংস্কৃতি' নামে। পরিচিতি লাভ করে।

৩. পূজাপার্বণ : কলকাতায় ছিল বারাে মাসে তেরাে পার্বণ, অর্থাৎ চড়কপূজা, নীলষষ্ঠী, রাসলীলা, রথযাত্রা, মাহেশের স্নানযাত্রা, বারােয়ারি দুর্গাপূজা ইত্যাদি নানা ধরনের উৎসব।

৪. সংস্কৃতি : নীলের ব্রত, গাজন সন্ন্যাসী (চড়কি)-দের শিবের কাছে মাথা দোলানাে বা মাথাচালা, যাত্রাগান, বুলবুলের গান, অশ্লীল শব্দযুক্ত আখড়াই গান ছিল তৎকালীন সংস্কৃতির অঙ্গ। আবার বাইজি নাচ ও মদ্যপান সংস্কৃতিও ছিল কলকাতার বাবু সমাজের একটি বিশেষ দিক।

উপসংহার : উপরােক্ত আলােচনা থেকে দেখা যায় যে, উনিশ শতকে কলকাতার সমাজজীবনে পরিবর্তন এসেছিল এবং এর মূল কারণ ছিল বাঙালিদের ইংরেজ অনুকরণ ও পাশ্চাত্য শিক্ষা। 

প্রশ্ন (৫) নীলদর্পণ' নাটক ও তার গুরুত্ব বিশ্লেষণ করাে।

উত্তর:- উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণের সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান ছিল নীলবিদ্রোহ কালে দীনবন্ধু মিত্রের রচিত নীলদর্পণ' (১৮৬০ খ্রিস্টাব্দ) নাটক।

নাটকের বিষয় : এই নাটকের মধ্য দিয়ে কৃষক সমাজ, নীলকরদের অত্যাচার ও কৃষকের সংগ্রামের কথা প্রতিফলিত হয়েছিল, যেমন—

১. নীলকরদের অত্যাচার : এই নাটকে সাধারণ প্রজাদের ওপর নীলকর সাহেবদের অত্যাচার ও লুঠতরাজ, গৃহদাহ, নরহত্যা, নারী নির্যাতনের বিবরণ পাওয়া যায়।

২. প্রতিক্রিয়াশীল শ্রেণি : ইংরেজদের সাহায্যকারী দেশীয় আমিন, গােমস্তা, পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেটদের কথা, তৎকালীন সমাজের আইন-আদালতের চিত্র এই নাটকে প্রতিফলিত হয়েছে।

৩. জোটবদ্ধতা : নীলকরদের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা আন্দোলনে রায়ত, সম্পন্ন কৃষক, মধ্যবিত্ত শ্রেণি একজোট হয়ে নীলচাষের বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদ করেছিল তা ধরা পড়ে এই নাটকে, যা ভারতীয়দের দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করেছিল।

গুরুত্ব : নীলদর্পণ নাটক বিভিন্ন কারণে গুরুত্বপূর্ণ, যেমন— 

১. কৃষক প্রীতি : বাংলার সাহিত্য জগতে নীলদর্পণ নাটকেই প্রথম বাংলার কৃষকদের দুর্দশার চিত্র উপস্থাপিত হয়েছিল।

২. নীলকরদের স্বরূপ প্রকাশ : নীল বিদ্রোহ ও ‘নীল কমিশন’ গঠনের পর এই নাটকটি প্রকাশিত হলে পাদরি জেমস্ লং এই নাটকটির ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করেন এবং ইউরােপের জনমানসে নীলকরদের অত্যাচার তুলে ধরতে সচেষ্ট হন।

৩. পেশাদারি নাটকের সূচনা : নীলদর্পণ' প্রকাশের পর নাটকটির জনপ্রিয়তার কারণে প্রথমে ঢাকায় ও পরে কলকাতায় (১৮৬২ খ্রি.) নাটকটি অভিনীত হয়। একারণেই গিরিশ্চন্দ্র ঘােষ নীলদর্পণ নাটকের স্রষ্টা দীনবন্ধু মিত্রকে বাংলার রঙ্গালয়ের স্রষ্টা' বলে অভিহিত করেছেন।

প্রশ্ন (৬) ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা' পত্রিকা ও তার অবদান সম্পর্কে একটি টীকা লেখাে। 

উত্তর:-  ভূমিকা : কুমারখালি পাঠশালার পণ্ডিত হরিনাথ মজুমদার ('কাঙাল হরিনাথ’) গ্রামবার্তা প্রকাশিকা' পত্রিকাটি সম্পাদনা করতেন। নিদারুণ আর্থিক দুরবস্থা, পরিকাঠামােগত অসুবিধে সত্ত্বেও দীর্ঘ বাইশ বছর ধরে তিনি এই পত্রিকাটি প্রকাশ করেন, যাতে সমাজের নিপীড়িত, অত্যাচারিত, অবহেলিত মানুষের অবস্থা পরিবেশিত হয়েছে।

গ্রামবার্তা প্রকাশিকার বৈশিষ্ট্য :হরিনাথ মজুমদার বা কাঙাল হরিনাথ’ কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত গ্রামবার্তা প্রকাশিকা' ছিল। এক সাময়িক পত্রিকা। এই পত্রিকার মাধ্যমে তিনি - 

প্রথমত, গ্রাম ও গ্রামবাসী প্রজার অবস্থা সহ সমসাময়িক বিভিন্ন খবরও প্রকাশিত হত।

দ্বিতীয়ত, ব্রিটিশ সরকার ও তার সহযােগী জমিদার ও মহাজন কর্তৃক প্রজা শােষণ ও অত্যাচারের কথা প্রকাশিত হয়েছিল। এমনকি জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত ঠাকুরবাড়ির জমিদারি ব্যবস্থাও তার সমালােচনার হাত থেকে রেহাই পায়নি।

তৃতীয়ত, এই পত্রিকায় সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান ও বীরগাথাও প্রকাশিত হয়েছিল।

অবদান : ‘গ্রামাবার্তা প্রকাশিকা' পত্রিকা, উনিশ শতকের গ্রামীণ সমাজে আলােড়ন তুলেছিল, কারণ—

প্রথমত, এর আগের সমস্ত পত্রপত্রিকা কলকাতা থেকে। প্রকাশিত হয়েছিল বলে তাতে শহরের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানসিক প্রতিফলন ধরা পড়েছিল, কিন্তু গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’ শুধু গ্রাম থেকেই প্রকাশিত হয়।

দ্বিতীয়ত, এতে গ্রামের মানুষের দুঃখ, দুর্দশা, বনা, নিপীড়নের কথা, নীলকরদের অত্যাচারের কথা তুলে ধরা হয়েছিল বলেই এটি ছিল ব্যতিক্রমী পত্রিকা।

তৃতীয়ত, এটিই ছিল বাংলার গ্রামীণ সংবাদপত্রের জনক। 

প্রশ্ন (৭) ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তারে খ্রিস্টান মিশনারিদের অবদান কী ছিল ?

উত্তর:- ভূমিকা : ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার সূচনা শুরু হয়েছিল বেসরকারি ও খ্রিস্টান মিশনারিদের উদ্যোগে। খ্রিস্টান মিশনারিরা খ্রিস্টধর্ম প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে নিম্নবর্ণের মানুষদের খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করেছিল এবং এরা যাতে বাইবেল পাঠ করতে পারে। সেজন্যই ভারতে ইংরেজি স্কুল স্থাপনের নীতি গ্রহণ করেছিল। 

খ্রিস্টান মিশনারিদের অবদান :ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারে খ্রিস্টান মিশনারিদের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যেমন—

১. শ্রীরামপুর মিশনের উদ্যোগ : শ্রীরামপুরে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে উইলিয়াম কেরি, মার্শম্যান ও উইলিয়াম ওয়ার্ড নামে তিনজন খ্রিস্টান মিশনারি শ্রীরামপুর ব্যাপটিস্ট মিশন প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীকালে এই প্রতিষ্ঠান প্রায় ১২৬টি বিদ্যালয় স্থাপন করে এবং সেখানে প্রায় দশ হাজার ছাত্র পাশ্চাত্য শিক্ষালাভের সুযােগ পায়।

২. লন্ডন মিশনারি উদ্যোগ : লন্ডন মিশনারি সােসাইটির সদস্য বরাট মে প্রথমে চুঁচুড়ায় (১৭৯৫ খ্রি.) এবং পরবর্তীকালে অন্যত্র ৩৬টি ইংরেজি শিক্ষার বিদ্যালয় স্থাপন করেন। চার্চ মিশনারি সােসাইটি (১৭৯৯ খ্রি.) ছিল এরকম আরও এক মিশনারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

৩. মিশনারি ও উচ্চশিক্ষা : ভারতে উচ্চশিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রেও মিশনারিদের উল্লেখযােগ্য অবদান রয়েছে, যেমন (ক) ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে ব্যাপটিস্ট মিশনের উদ্যোগে শ্রীরামপুর কলেজ, (খ) ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে স্কটিশ মিশনের উদ্যোগে জেনারেল অ্যাসেম্বলি ইন্সটিটিউশন (পরবর্তীকালের পটিশ চার্চ কলেজ), (গ) বেলজিয়ামের মিশনারিদের উদ্যোগে কলকাতার সেন জেভিয়ার্স কলেজ (১৮৩৫ খ্রি.) ও লরেটো হাউস পিত হয়। 

উপসংহার: পাত্য শিক্ষাবিস্তারের (এ ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে। এইসব খ্রিস্টান মিশনারিদের তো কোনাে বিরােধ বাধেনি। অন্যদিকে মিশনারিদের নেতৃত্বে পাচাত্য শিক্ষার বিস্তার ভারতীয়দেবালে এক নতুন প্রজ্ঞা জগতের সন্ধান দিয়েছিল।

প্রশ্ন (৮) প্রাচ্য-পাশ্চাত্য বিতর্ক কী ?

উত্তর:- ভূমিকা : ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের চার্টার অ্যাক্টে এদেশের শিক্ষাখাতে প্রতি বছর এক শ টাকা বরাদ্দকরণ ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। কিন্তু এই টাকা প্রাচ্য না পাশচাত্য শিক্ষা প্রসারে খরচ করা হবে সে সম্পর্কে ১৮২০ র দশকে এক বিতর্ক সৃষ্টি হয়, যা প্রাচ্যশিক্ষা পাশ্চাত্য শিক্ষা-বিষয়ক দ্বন্দু বা প্রাচ্য-পাশ্চাত্য বিতর্ক নামে পরিচিত।

বিতর্ক : ওই সময়ে যারা প্রাচ্য ভাষার (সংস্কৃত, আরবি, ফারসি) মাধ্যমে শিক্ষাচর্চার কথা বলেন তারা প্রাচ্যবাদী এবং যারা ইংরেজির মাধ্যমে শিক্ষাচর্চার কথা বলেন তারা পাশ্চাত্যবাদী নামে পরিচিত হন। এইচ. টি. প্রিন্সেপ, কোলবুক, হােরেস হেম্যান উইলসন প্রমুখ প্রাচ্যবাদীর মত ছিল দেশীয় ভাষার মাধ্যমে শিক্ষার বিস্তার ঘটানো হােক এবং এঁদের উদ্যোগেই প্রতিষ্ঠিত হয় কলকাতা সংস্কৃত কলেজ (১৮২৪ খ্রি.)। অন্যদিকে, লর্ড মেকলে, চার্লস গ্রান্ট প্রমুখ পাশ্চাত্যবাদীর উদ্দেশ্য ছিল মূলত ইরেজি ভাষার মাধ্যমে শিক্ষার বিস্তার ঘটানাে। ভারতীয়দের মধ্যে রাজা রামমােহন রায় ছিলেন পাশ্চাত্যবাদী (যিনি তৎকালীন বড়ােলটি আমহার্টকে একটি চিঠির মাধ্যমে সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারের আবেদন জানান), পক্ষান্তরে রাজা রাধাকান্ত দেব প্রমুখ ছিলেন প্রাচ্যবাদী।

সরকারি শিক্ষানীতি : ভারতে ইংরেজি শিক্ষাবিস্তারের ক্ষেত্রে এই প্রাচ্যবাদী-পাশ্চাত্যবাদী বিতর্কে শেষ পর্যন্ত ‘মেকলে মিনিট (২ ফেব্রুয়ারি, ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দ)-এর মাধ্যমে পাশ্চাত্যবাদীদের মতই সুপ্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দের ৮ মার্চ গভরি জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক ইংরেজি ভাষায় শিক্ষার প্রসারকে ‘সরকারি নীতি’ বলে ঘােষণা করেন।

উপসংহার : ভারতের বাংলা প্রদেশে প্রাচ্য-পাশ্চাত্য বিতর্ক শুরু হলেও বােম্বাই প্রদেশ-সহ অন্যান্য প্রদেশে অনুরূপ বিতর্ক হয়নি, বরং এই স্থানগুলিতে পাশ্চাত্য শিক্ষানীতিই গৃহীত হয়েছিল।

প্রশ্ন (৯) মেকলে মিনিট কেন প্রবর্তিত হয় তা বিশ্লেষণ করে এর গুরুত্ব চিহ্নিত করাে।

উত্তর :- ভূমিকা : ভারতে সরকারি উদ্যোগে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারের ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ দিকচিহ্ন ছিল ‘মেকলে মিনিট (২ ফেব্রুয়ারি ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দ)।

মেকলে মিনিট : বড়ােলট উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের শাসনকালে টমাস ব্যাবিংটন মেকলে ১৮৩৪ খ্রিস্টাব্দে বড়ােলাটের পরিষদে আইন সদস্যরূপে যােগ দেন ও পরবর্তীকালে শিক্ষাসভার সভাপতি হন। তিনি ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারে সচেষ্ট হন এবং ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তনের সুপারিশ করেন যা ‘মেকলে মিনিট’ নামে পরিচিত। তাঁর মতের সমর্থনে যুক্তি দেন যে— 

১. ভারতীয় ভাষার দৈন্যতা : তার মতে, সমস্ত ভারত ও আরবের যে প্রাচীন সাহিত্য রয়েছে তা ইউরােপীয় ভাষা অপেক্ষা নিকৃষ্টতর হওয়ায় ভারতীয়দের মাতৃভাষাগুলি শিক্ষার বাহনরূপে যথার্থ ভূমিকা পালনে অক্ষম।

২. ইংরেজি ভাষার গুরুত্ব : তিনি মনে করেন যে, ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য হল জ্ঞানবিজ্ঞানের এক অফুরন্ত খনি।

৩. ইংরেজি জানা কর্মচারী :ইংরেজি ভাষা প্রবর্তিত হলে ভারতে নবজীবনের সূচনার পাশাপাশি ব্রিটিশ প্রশাসনে ইংরেজি ভাষা জানা কর্মচারী নিয়ােগ করাও সম্ভব হবে।

মেকলে মিনিট প্রবর্তনের মাধ্যমে (অর্থাৎ, সরকারি অর্থ পাশ্চাত্য ভাষা ও জ্ঞান বিজ্ঞান শিক্ষার প্রসারে ব্যয় করা হবে) ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারের নীতি গৃহীত হওয়ায় ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের ইতিহাসে এটি ছিল খুব তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা।

প্রশ্ন (১০) টীকা লেখাে : উডের ডেসপ্যাচ। অথবা, চার্লস উডের নির্দেশনামা কী ? 

উত্তর:- ভূমিকা : ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারের ক্ষেত্রে দুটি গুরুত্বপূর্ণ দিকচিহ্ন হল—১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দের মেকলে মিনিট ও ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দের উডের ডেসপ্যাচ বা নিদের্শনামা।

উডের ডেসপ্যাচ : ভারতবর্ষের শিক্ষা সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যার সমাধানের জন্য ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে বাের্ড অফ কন্ট্রোলের সভাপতি চার্লস উড শিক্ষা সংক্রান্ত এক নির্দেশনামা জারি করেন যা উডের ডেসপ্যাচ নামে পরিচিত।

সুপারিশ : ভারতের আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার প্রসারের জন্য চার্লস উডের বিভিন্ন সুপারিশের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিল : (১) নিম্নতম শ্রেণি থেকে উচ্চতর শ্রেণি পর্যন্ত যথাযথ সমন্বয়মূলক শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন; (২) সরকারি শিক্ষাবিভাগ স্থাপন; (৩) প্রত্যেক প্রেসিডেন্সি শহরে (অর্থাৎ-কলকাতা, বােম্বাই ও মাদ্রাজ শহরে) একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন; (৪) গণশিক্ষা, নারীশিক্ষা, মাতৃভাষার উন্নয়ন এবং শিক্ষক-শিক্ষণ ব্যবস্থার , প্রবর্তন; (৫) সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা প্রদান নীতির প্রবর্তন প্রভৃতি।

প্রভাব : চার্লস উডের এইসব সুপারিশের ওপর ভিত্তি করেই আধুনিক ভারতের শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল, যেমন— (১) চার্লস উড-এর সুপারিশ অনুসারে ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে সরকারি শিক্ষা বিভাগ খােলা হয়। (২)‘উডের নির্দেশনামা’র ফলশ্রুতি হিসেবে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা, মাদ্রাজ ও বােম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা হয়। (৩) বহু বিদ্যালয়কে সরকারি অনুদান প্রদান এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ফলে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার দ্রুত প্রসার ঘটতে থাকে।

প্রশ্ন (১১) ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলাফল কী হয়েছিল ?

উত্তর:- ভূমিকা : ভারতে প্রথমে বেসরকারি ও পরে সরকারি উদ্যোগে পরিচালিত পাশ্চাত্য শিক্ষাব্যবস্থা বহুমুখী ও ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিল।

ফলাফল : উনিশ শতকের ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবগুলি হল - 

১. যুক্তিবাদের প্রসার : পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতির সংস্পর্শে আসার ফলে ভারতবাসীর মধ্যে কুসংস্কারাচ্ছন্ন মধ্যযুগীয় ধ্যানধারণার পরিবর্তন ঘটে এবং যুক্তিবাদী ধ্যানধারণার প্রতিষ্ঠা হয়। পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে ভারতে যুক্তিবাদী শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব হয়।

২. পাশ্চাত্যবাদী আদর্শের প্রসার : পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে ভারতবাসীর একাংশ পাশ্চাত্য সভ্যতার ইতিহাস, জ্ঞানবিজ্ঞান, মানবতাবাদ, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, যুক্তিবাদ প্রভৃতি উচ্চ আদর্শের সঙ্গে পরিচিত হয়ে ওঠে।

৩. ধর্ম ও সমাজসংস্কার : পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে উনিশ শতকের শিক্ষিত ভারতীয়রা কুসংস্কারমুক্ত হয়ে ওঠে এবং তাদের মধ্যে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, রাজনীতি, সমাজতন্ত্র প্রভৃতি বিষয়ে প্রগতিমূলক চিন্তাভাবনার উন্মেষ হয়। ভারতে নারীশিক্ষা ও নারীমুক্তি আন্দোলন, ধর্মসংস্কার ও সমাজসংস্কার আন্দোলন শুরু হয়।

৪. জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ : ভারতে জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ ঘটে, যা পরবর্তীকালে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে পরিণতি লাভ করেছিল।

উপসংহার : পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ভারতীয়রা প্রথমে সমাজসংস্কারমূলক কাজ এবং পরবর্তীকালে দেশের স্বাধীনতার কাজে আত্মনিয়ােগ করেছিলেন। তবে পাশ্চাত্য শিক্ষার কয়েকটি কুপ্রভাবও ছিল—যেমন, (১) ভারতীয় ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি অবহেলা, (২) বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষায় অবহেলা, (৩) অবহেলিত নারীশিক্ষা ও গণশিক্ষা, (৪) পরােক্ষভাবে খ্রিস্টধর্মের প্রচার প্রভৃতি।

প্রশ্ন (১২) নারীশিক্ষা প্রসারে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান সংক্ষেপে আলােচনা করাে।

উত্তর :- ভূমিকা : উনিশ শতকের বিখ্যাত সংস্কৃত পণ্ডিত ও সমাজসংস্কারক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-৯১ খ্রি.)। নারীমুক্তির উদ্দেশ্যে সারাজীবন ধরে শিক্ষাবিস্তার ও সমাজসংস্কারে সচেষ্ট হয়েছিলেন।

প্রেক্ষাপট : নারীশিক্ষা প্রসারে বিদ্যাসাগরের লক্ষ্য ছিল দুটি, যথা—

প্রথমত, বিদ্যাসাগর বিধবাবিবাহ প্রবর্তন, বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহ রােধ, এবং বিভিন্ন সামাজিক কুপ্রথার বিরুদ্ধে প্রবল জনমত গড়ে তােলার পাশাপাশি অনুভব করেন নারী মুক্তির জন্য প্রয়ােজন নারীশিক্ষা।

দ্বিতীয়ত, নারীকে শিক্ষিত করে তােলা সম্ভব হলে প্রজন্মও শিক্ষিত হয়ে উঠবে বলে তিনি বিশ্বাস করতেন।

নারীশিক্ষা বিস্তারে অবদান :

১. স্কুল প্রতিষ্ঠা : বিদ্যাসাগর বিদ্যালয় দক্ষিণবঙ্গের পরিদর্শকের সরকারি পদে থাকার (১৮৫৭-৫৮ খ্রি.) সুযােগে বাংলার বিভিন্ন স্থানে ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় এবং ১০০টি বাংলা স্কুল স্থাপন করেন। ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে বেথুন সাহেবের উদ্যোগে ‘হিন্দু ফিমেল স্কুল প্রতিষ্ঠাকালে তিনি বিভিন্নভাবে সাহায্য করেন।

২. ভগবতী বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা : বিদ্যাসাগর তার নিজের জন্মস্থান মেদিনীপুরের বীরসিংহ গ্রামে মা ভগবতী দেবীর পুণ্য স্মৃতি রক্ষার্থে। প্রতিষ্ঠা করেন ভগবতী বিদ্যালয় (১৮৯০ খ্রি.)।

৩. নারী শিক্ষা ভাণ্ডার : তাঁর প্রতিষ্ঠিত বালিকা বিদ্যালয়গুলিকে সরকার আর্থিক সাহায্যদান বন্ধ করলে বিদ্যাসাগর নারীশিক্ষা ভাণ্ডার' নামে একটি তহবিল গঠন করেছিলেন।

৪. স্ত্রী শিক্ষা সম্মিলনী : বিদ্যাসাগর নারীশিক্ষার যথাযথ প্রসারের জন্য মেদিনীপুর হুগলি বর্ধমানসহ বিভিন্ন জেলায় স্ত্রীশিক্ষা সম্মিলনী’ নামক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

উপসংহার : বিদ্যাসাগর নারীশিক্ষার প্রসার ও নারী সমাজের উন্নতির জন্য যুক্তির চেয়ে হিন্দু ধর্মশাস্ত্রের ওপর বেশি নির্ভর করেন। তাই ঐতিহাসিক অমলেশ ত্রিপাঠী তাঁকে ‘ঐতিহ্যবাহী আধুনিককার বলে অভিহিত করেছেন।

প্রশ্ন (১৩) কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের প্রতিষ্ঠাকে তুমি কীভাবে বিশ্লেষণ করবে ?

উত্তর :- ভূমিকা : ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ভারতে ব্রিটিশ জনস্বাস্থ্য নীতির প্রথম প্রতিফলন ঘটে।

প্রেক্ষাপট : কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠা আকস্মিক ছিল না। এর পশ্চাতে দেখা যায় যে,

১. চিকিৎসাক্ষেত্রে বিবিধ অভাব : ১৮২০-র দশকে প্রতিষ্ঠিত স্কুল ফর নেটিভ ডক্টরস, সংস্কৃত কলেজ ও কলকাতা মাদ্রাসার চিকিৎসাবিদ্যা বিভাগে ব্যাবহারিক অঙ্গ ব্যবচ্ছেদ ব্যবস্থা ছিল না। এবং ব্যাপক পরিসরে চিকিৎসা প্রদানেরও অভাব ছিল।

২. কমিটি গঠন : এই বিবিধ অভাব পূরণের জন্য লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক একটি কমিটি গঠন করেন (১৮৩৩ খ্রি.), যার সভাপতি ছিলেন মি জে গ্র্যান্ট এবং অন্যান্য সদস্য ছিলেন জে সি সাদারল্যান্ড, সি জি সাদারল্যান্ড, এম জে ব্রামলি, বাবু রামকমল সেন প্রমুখ। এই কমিটি সংস্কৃত ও আরবি-ফারসির পরিবর্তে ইংরেজির মাধ্যমে পাশ্চাত্য চিকিৎসাবিজ্ঞানের শিক্ষাদানের সুপারিশ করে।

২. বেন্টিঙ্কের পদক্ষেপ : লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক উপরােক্ত কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে সংস্কৃত কলেজ ও মাদ্রাসার চিকিৎসাবিদ্যার বিভাগ এবং নেটিভ মেডিক্যাল স্কুল বন্ধ করার (১ ফেব্রুয়ারি ১৮৩৫ খ্রি.) পাশাপাশি এদেশীয় যুবকদের চিকিৎসাশাস্ত্রের বিভিন্ন বিভাগে ইংরেজিতে শিক্ষিত করে তােলার উদ্দেশ্যে একটি নতুন মেডিক্যাল কলেজ স্থাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।

উপসংহার : গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুসারে ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে নির্বাচিত ৪৯ জন ছাত্রকে নিয়ে মেডিক্যাল কলেজের ক্লাস শুরু হয়। এভাবে ভাতে পাশ্চাত্য চিকিৎসাবিদ্যার বিকাশ শুরু হয়। 

প্রশ্ন (১৪) এদেশের চিকিৎসাবিদ্যার ক্ষেত্রে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের ভূমিকা কীরূপ ছিল ?

উত্তর :- ভূমিকা : ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ভারতে ব্রিটিশ জনস্বাস্থ্য নীতির প্রথম প্রতিফলন ঘটে। মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ভারতে পাশ্চাত্য চিকিৎসাবিদ্যার বিকাশ শুরু হয়।

মেডিক্যাল কলেজের ভূমিকা : আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যার চর্চায় কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের ভূমিকা ছিল এরকম—

 ১. প্রশিক্ষণ : পাশ্চাত্য চিকিৎসাবিদ্যার প্রশিক্ষণের জন্য ১৪ থেকে ২০ বছর বয়সি ১০০ জন ছাত্রের ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার পর নির্বাচিত ৪৯ জন ছাত্রকে নিয়ে মেডিক্যাল কলেজের প্রথম ক্লাস শুরু হয়।

২. পাঠ্য বিষয় : মেডিক্যাল কলেজে তত্ত্বগত ও ব্যবহারিক অ্যানাটোমি, তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক রসায়নবিদ্যা, তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক মেডিসিন চিকিৎসা, ব্যবহারিক ঔষধ প্রস্তুতকরণ শেখানাে হত। প্রথম দিকে পাঠদানের মাধ্যম ইংরেজি হলেও পরবর্তীকালে দেশীয় ভাষার ব্যবহার শুরু হয়।

৩. বহির্বিভাগ : মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠার পরবর্তীকালে প্রথমে ২০ শয্যাবিশিষ্ট ও বহির্বিভাগ যুক্ত একটি হাসপাতাল স্থাপন করা হয় (১৮৩৮ খ্রি.) এবং পরবর্তীকালে মেডিক্যাল কলেজ প্রাঙ্গণে ১০০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল তৈরি করা হয়।

৪. ছাত্রদের বিদেশে প্রেরণ : মেডিক্যাল কলেজের সুপারিনটেনডেন্ট ডা. ব্রামলির পরিকল্পনার সূত্র ধরে কলেজের মেধাবী ছাত্রদের ইংল্যান্ডে প্রেরণ করে উচ্চমানের মেডিক্যাল শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয় (৮ মার্চ, ১৮৪৫ খ্রি.)। ভােলানাথ বসু, দ্বারকানাথ বসু, সূর্যকুমার চক্রবর্তী ও গােপালচন্দ্র শীল ছিলেন প্রথম বিলাতফেরত ডাক্তার।

উপসংহার : কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ ছিল এশিয়া মহাদেশের দ্বিতীয় কলেজ। এই কলেজের প্রথম ব্যাচে পাস করা উমেশচন্দ্র শেঠ, রাজকৃষ্ণু দে, দ্বারকানাথ গুপ্ত প্রমুখ ডাক্তারদের ঢাকা, মুরশিদাবাদ, পাটনা প্রভৃতি স্থানের হাসপাতালের কাজে নিযুক্ত করা হয়। এভাবে এই কলেজ ভারতের চিকিৎসাবিদ্যার অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

প্রশ্ন (১৫) ভারতে পাশ্চাত্য চিকিৎসাবিদ্যার বিকাশে পণ্ডিত মধুসূদন দত্তের অবদান বিশ্লেষণ করাে।

উত্তর:- ভূমিকা : ভারতে পাশ্চাত্য চিকিৎসাবিদ্যার বিকাশে হুগলি জেলার বৈদ্যবাটি গ্রামে জন্মগ্রহণকারী মধুসূদন গুপ্তের (১৮০৬-১৮৫৬ খ্রি.) ভূমিকা ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ।

অবদান : ডা. মধুসূদন গুপ্ত যেভাবে ভারতে পাশ্চাত্য চিকিৎসা বিদ্যার বিকাশে সাহায্য করেন তা হল - 

১. হিন্দু ওষুধের পণ্ডিত : তিনি ছিলেন কলকাতা সংস্কৃত কলেজের ছাত্র। এবং পরবর্তীকালে এই কলেজে তিনি হিন্দু ওষুধের পণ্ডিতরূপে নিযুক্ত হন (১৮৩০ খ্রি.)।

২. অ্যাসিস্ট্যান্ট সার্জেন : কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি এখানে ডাক্তাররূপে যােগদান করেন ও পরবর্তীকালে তিনি প্রথম মর্যাদার সাব অ্যাসিস্ট্যান্ট সার্জেন হন।

৩. শব ব্যবচ্ছেদ :১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দের ১০ জানুয়ারি হিন্দু কুসংস্কার উপেক্ষা করে নিজ হাতে শব ব্যবচ্ছেদ করেন এবং এর দশ মাস পর ডাক্তার গুডিভের তত্ত্বাবধানে চারজন মেডিক্যাল ছাত্র (রাজকৃয় দে, উমাচরণ শেঠ, দ্বারকানাথ গুপ্ত ও নবীনচন্দ্র মিত্র)-কে সাথে নিয়ে পুনরায় শব ব্যবচ্ছেদ করেন। 

৪. গ্রন্থ রচনা : সংস্কৃত কলেজে অধ্যাপনাকালে মধুসূদন গুপ্ত হুপারের ‘অ্যানাটমিস্টস ভাডে–মেকাম' গ্রন্থটির সংস্কৃত অনুবাদ করেন (১৮৩৫ খ্রি.) এবং পরবর্তীকালে ‘লন্ডন ফার্মাকোপিয়া’ গ্রন্থটির বাংলা অনুবাদ করেন (১৮৪৯ খ্রি.)। এ ছাড়া তিনি ইংরাজি ও ল্যাটিন ওষুধের নাম ও ব্যবহারের নির্দেশাবলি সম্পর্কিত অনুবাদ গ্রন্থ ‘অ্যানাটোমি’ (১৮৫৩ খ্রি.) রচনা করেন।

উপসংহার : ভারতে পাশ্চাত্য চিকিৎসাবিদ্যার বিকাশের ক্ষেত্রে ডা. মধুসূদন গুপ্তের ভূমিকাকে স্মরণ করে শিক্ষা কাউন্সিলের সভাপতি জে ডি বেথুন মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষকে ডা. মধুসূদন গুপ্তের এক বিশাল তৈলচিত্র উপহার দেন (১৫ জুন, ১৮৪৯ খ্রি.)। এটি বর্তমানে মেডিক্যাল কলেজে জি. এল. টি হলে সংরক্ষিত আছে।

প্রশ্ন (১৬) কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও তার তাৎপর্য বিশ্লেষণ করাে।

উত্তর:- ভূমিকা : ভারতে শিক্ষা তথা উচ্চশিক্ষার বিকাশে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিচিহ্ন হল উডের ডেসপ্যাচের সুপারিশ অনুযায়ী লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুকরণে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা (১৮৫৭ খ্রি.)।

প্রতিষ্ঠা : কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় - 

১. ইউনিভার্সিটি কমিটি : উডের ডেসপ্যাচের সুপারিশের ভিত্তিতে লর্ড ডালহৌসির শাসনকালে গঠিত ইউনিভার্সিটি কমিটির দেওয়া রিপাের্টের ওপর ভিত্তি করেই প্রতিষ্ঠিত হয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। (২৪ জানুয়ারি, ১৮৫৭ খ্রি.)। 

২. প্রশাসন : কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুসারে ৪১ জন সিনেট সদস্য নিয়ে গঠিত সিনেটের হাতে শিক্ষানীতি রূপায়ণের ভার ন্যস্ত করা হয়। লর্ড ক্যানিং হন প্রথম আচার্য এবং স্যার জেমস উইলিয়াম কোলভিল প্রথম উপাচার্য।

৩. বিস্তার : প্রতিষ্ঠাকালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাএলাকা ছিল লাহাের থেকে বর্তমান মায়ানমারের রেঙ্গুন পর্যন্ত। দেশের বিভিন্ন বিদ্যালয় ও কলেজ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছ থেকে অনুমােদন নেয়।

৪. কর্ম শুরু : কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট-এর প্রথম মিটিং হয় ৩০ জানুয়ারি, ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের কাউন্সিল রুম-এ। ক্যামাক স্ট্রিটের একটি ভাড়া বাড়িতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থায়ী অফিস গড়ে ওঠে। ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দের মার্চে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম এন্ট্রান্স পরীক্ষায় ২৪৪ জন পরীক্ষার্থী অংশগ্রহণ করে।

উপসংহার : কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ফলে ভারতের প্রাথমিক শিক্ষা থেকে উচ্চশিক্ষার বিষয়টি পরিপূর্ণতা লাভ করলেও প্রতিষ্ঠাকালে এটি উচ্চ শিক্ষাকেন্দ্র ছিল না, বরং তা ছিল পরীক্ষাগ্রহণকারী কেন্দ্র।

প্রশ্ন (১৭) পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারে রাজা রামমােহন রায়ের ভূমিকা আলােচনা করাে। 

উত্তর:- ভূমিকা : উনিশ শতকে ভারতবর্ষে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে রাজা রামমােহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দ) অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তাঁর ভূমিকা ছিল এরকম - 

১. পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার : পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করে রামমােহন পাশ্চাত্য দর্শন, গণিত, রসায়ন, অস্থিবিদ্যা প্রভৃতি শিক্ষার জন্য ব্যাপক প্রচার চালান।

২. ইংরেজি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা : ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে রাজা রামমােহন রায় নিজ উদ্যোগে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারের উদ্দেশ্যে কলকাতায় অ্যাংলাে-হিন্দু স্কুল নামে একটি ইংরেজি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। 

৩. সরকারি সহযােগিতার জন্য আবেদন : ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে রামমােহন লর্ড আমহার্স্টকে এক চিঠিতে শিক্ষাখাতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রদত্ত এক লক্ষ টাকা পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে ব্যবহারের জন্য আবেদন জানান।

৪. বেদান্ত কলেজ প্রতিষ্ঠা : কুসংস্কার দূর করে পাশ্চাত্য পদার্থবিদ্যা ও সমাজবিজ্ঞানের ধারণা প্রসারের উদ্দেশ্যে রামমােহন ১৮২৬ খ্রিস্টাব্দে বেদান্ত কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। 

           এ ছাড়াও ডেভিড হেয়ার, আলেকজান্ডার ডাফ প্রমুখ পাশ্চাত্য শিক্ষার সমর্থকদের তিনি নানাভাবে সমর্থন ও সহযােগিতা করেন এবং হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক পর্বে যুক্ত হয়েছিলেন।

প্রশ্ন (১৮) রাজা রামমােহন রায়কে কেন ভারতের প্রথম আধুনিক মানুষ মনে করা হয় ?

উত্তর:- ভূমিকা : উনিশ শতকে ভারতবর্ষের সামাজিক পটভূমিতে রাজা রামমােহন রায় সর্বপ্রথম কুসংস্কার ও কুপ্রথা দূর করে জাতীয় জীবনে জাগরণ ঘটাতে সচেষ্ট হন।

অবদান : রাজা রামমােহন রায় ধর্মসংস্কার, সমাজসংস্কার প্রভৃতি বহুমুখী কাজে আত্মনিয়ােগ করেন, এগুলি হল—

১. মানবতাবাদের প্রচার : উনিশ শতকের প্রথম উল্লেখযােগ্য যুক্তিবাদী ও মানবতাবাদী মানুষ রাজা রামমােহন রায় ছিলেন উনিশ শতকের ভারতে ধর্মসংস্কার ও সমাজসংস্কার আন্দোলনের পুরােধা পুরুষ।

২. সমাজসংস্কার : রামমােহন তার যুক্তিবাদী আধুনিক চিন্তাধারার সাহায্যে সমস্ত বাধাবিঘ্নকে অতিক্রম করে সতীদাহপ্রথা, বহুবিবাহ, বর্ণভেদ প্রথা প্রভৃতি সামাজিক কুসংস্কার ও কুপ্রথার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেন এবং সতীদাহপ্রথা রদ করতে সক্ষম হল। 

৩. আধুনিক চিন্তাধারার প্রচলন : উনিশ শতকের ভারতীয় জীবনে ধর্ম, শিক্ষা, সমাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি প্রভৃতি বিষয়ে যুক্তিবাদী ও মানবতাবাদী আধুনিক চিন্তাধারার পথিকৃৎ ছিলেন রাজা রামমােহন রায়। এইসব কারণের জন্য রামমােহন রায়কে ভারতের প্রথম আধুনিক মানুষ’ বলা হয়।

উপসংহার : রামমােহন রায়ের কতকগুলি সীমাবদ্ধতা ছিল, যেমন—তিনি সমাজ ও ধর্মের কোনাে মৌলিক পরিবর্তন ঘটাননি। তাই ঐতিহাসিক সালাউদ্দিন আহম্মদ তাকে সংযত সংস্কারক বলে অভিহিত করেছেন।

প্রশ্ন (১৯) রাজা রামমােহন রায় কীভাবে সতীদাহপ্রথার বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন তা ব্যাখ্যা করাে। অথবা, সতীদাহ প্রথা কেন নিষিদ্ধ হয় ?

উত্তর:- ভূমিকা : অষ্টাদশ শতকের সূচনায় কলকাতা-সহ বাংলায় গড়ে ওঠা সতীদাহ প্রথাবিরােধী আন্দোলনে যুক্তিবাদী ও মানবতাবাদী রামমােহন রায় যুক্ত হন ও সাফল্যের সঙ্গে এই আন্দোলন পরিচালনা করেন।

রামমােহন রায়ের অবদান : যুক্তিবাদী ও মানবতাবাদী রামমােহন রায় নিজেকে সতীদাহ বিরােধী আন্দোলনে যুক্ত করেন। 

১. নারী-হত্যা : রামমােহন মত প্রকাশ করেন যে, সতীদাহের অধিকাংশ ঘটনাই স্বেচ্ছাপ্রণােদিত ছিল না, তা ছিল বলপূর্বক নারী-হত্যা। সমসাময়িককালের বিভিন্ন তথ্য ও সরকারি নথিপত্র থেকেও এই বক্তব্য সমর্থিত হয়।

২. স্বতঃস্ফূর্ত রদ : রামমােহন রায় আইনের পরিবর্তে মানুষের মধ্যে শিক্ষা ও চেতনার প্রসারের মাধ্যমেই এই প্রথা রদ করতে চেয়েছিলেন। অর্থাৎ স্বতঃস্ফূর্তভাবেই মানুষ একদিন এই প্রথার অবসান ঘটাবে বলে তিনি বিশ্বাস করতেন।

৩. চেতনা সৃষ্টি : রামমােহন রায় সতীদাহ বিরােধী চেতনা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় গ্রন্থ রচনা করে সতীদাহ প্রথাকে অশাস্ত্রীয় প্রমাণ করতে সচেষ্ট হন। এ ছাড়া সংবাদপত্রে বিভিন্ন রচনার মাধ্যমে জনগণের চেতনা সঞ্জুর করেন। প্রচারসভার পাশাপাশি শ্মশানে শ্মশানে ঘুরে স্বামীর চিতায় সতী হতে ইচ্ছুক বিধবাদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেন।

৪. বেন্টিঙ্কের উদ্যোগকে সমর্থন : রামমােহন রায় সতীদাহপ্রথা উচ্ছেদের জন্য সরকারি সমর্থনের ওপর নির্ভর করেন। অবশেষে ১৮২৭ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ ইংল্যান্ডের জনগণের একাংশ নিষ্ঠুর সতীদাহ প্রথা বন্ধের জন্য আবেদন জানালে তৎকালীন বডােলাট লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে সপ্তদশ বিধি (১৭নং রেগুলেশান) জারি করে এই প্রথা রদ করেন।

মূল্যায়ন : সতীদাহপ্রথা বিরােধী আন্দোলন শুধু রামমােহন রায়ের গড়ে তােলা আন্দোলন ছিল না, বরং আগেই গড়ে ওঠা এক আন্দোলন। তবে এই আন্দোলন তাঁর আন্তরিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে শেষপর্যন্ত সাফল্য লাভ করে।

প্রশ্ন (২০) সতীদাহপ্রথা বিরােধী আন্দোলন বিশ্লেষণ করাে।

উত্তর:- ভূমিকা : মৃত স্বামীর চিতায় তার সদ্যবিধবা জীবন্ত স্ত্রীর সহমরণ সতীদাহপ্রথা নামে পরিচিত।

আন্দোলন : বাংলা তথা ভারতের সমাজসংস্কার আন্দোলনে সতীদাহপ্রথা বিরােধী আন্দোলন ছিল একটি ব্যাপক আন্দোলন। এর বিভিন্ন দিক হল—

১. সার্বিক আন্দোলন : প্রাচীনকাল থেকেই ভারতে প্রচলিত সতীদাহপ্রথা গোঁড়া হিন্দুদের কাছে পবিত্র ও মহান প্রথা হলেও বাস্তবে তা অত্যন্ত নিষ্ঠুর হওয়ায় এই প্রথার বিরুদ্ধে উনিশ শতকে কলকাতা-সহ বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে আন্দোলন গড়ে ওঠে।

২. সরকারি নিয়ন্ত্রণ : সতীদাহপ্রথার ব্যাপকতায় চিন্তিত ইংরেজ সরকার ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে একটি আইনের মাধ্যমে গর্ভবতী ও অল্পবয়সি নারীর সতী হওয়া নিষিদ্ধ ঘােষণা করে।

৩. রামমােহনের চেষ্টা : মানবতাবাদী ও যুক্তিবাদী রাজা রামমােহন রায় সতীদাহপ্রথা বিরােধী প্রচারসভা ও প্রচারপুস্তিকার মাধ্যমে এই প্রথার বিরােধিতা করেন ও সতীদাহপ্রথাকে অশাস্ত্রীয় বলে প্রমাণ করেন। সরকারের কাছে আবেদনপত্র প্রেরণ করে সরকারি আইনের সাহায্যে এই প্রথা রদে সচেষ্ট হন।

৪. ইংল্যান্ড ও বেন্টিঙ্কের উদ্যোগ : ১৮২৭ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ ইংল্যান্ডের জনগণ তাদের পার্লামেন্টের মাধ্যমে নিষ্ঠুর সতীদাহপ্রথা বন্ধের জন্য আবেদন জানায়। তৎকালীন বড়ােলাট লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কও এই প্রথার বিরােধী হওয়ায় তিনি ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে সপ্তদশ বিধি’ নামে আইন প্রবর্তন করে এই প্রথা রদ করেন। 

উপসংহার : উপরােক্ত আলােচনা থেকে দেখা যায় যে, রামমােহন রায়ের আগেই গড়ে ওঠা সতীদাহপ্রথা বিরােধী আন্দোলনকে তিনি সাফল্যের পথে এগিয়ে দেন।

প্রশ্ন (২১) টীকা লেখাে : ডিরােজিও।

উত্তর:- ভূমিকা : উনিশ শতকের প্রথমার্ধে হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরােজিওর (১৮০৯-১৮৩১ খ্রি.) নেতৃত্বে বাংলায় এক উগ্র সংস্কারবাদী আন্দোলনের অবতারণা হয়, যা নব্যবঙ্গ আন্দোলন নামে পরিচিত।

১. বাল্যকাল : ১৮০৯ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার এক ইউরেশিয়ান পরিবারে জন্মগ্রহণকারী ডিরােজিও হেনরি ড্রামন্ডের কাছে ধর্মতলা অ্যাকাডেমিতে শিক্ষালাভ করেন এবং পাশ্চাত্যের যুক্তিবাদী ধারণায় উদ্বুদ্ধ হন।

২. অধ্যাপনা : ১৮২৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি হিন্দু কলেজের শিক্ষক রূপে যােগ দেন ও কলেজের তরুণ ছাত্র-সম্প্রদায়ের মনে আলােড়ন সৃষ্টি করেন। প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিসের মতাে ডিরােজিও তার ছাত্রদের যুক্তিবাদী ও প্রগতিশীল চিন্তাধারার সঙ্গে পরিচয় ঘটান। 

৩. হিন্দু সমাজের সমালােচনা : তিনি ‘অ্যাকাডেমিক অ্যাসােসিয়েশন’ নামে এক সমিতি গঠন করেন এবং সেখানে আলােচনা সভার মাধ্যমে হিন্দু সমাজের কুসংস্কার, রক্ষণশীলতা ও প্রচলিত কুপ্রথাগুলির বিরুদ্ধে কশাঘাত করেন।

৪. কর্মচ্যুতি : ডিরােজিওর প্রভাবে তার ছাত্র সম্প্রদায় প্রকাশ্যে  হিন্দুধর্মের আচার-ব্যবহার লঙ্ঘন করতে থাকলে হিন্দুসমাজের রক্ষণশীল সমাজপতিরা কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে ডিরােজিওর বিরুদ্ধে নালিশ জানান এবং এর ফলে ডিরােজিও কর্মচ্যুত হন (এপ্রিল ১৮৩১)। ওই বছরের শেষে কলেরায় আক্রান্ত হয়ে ডিরােজিওর মৃত্যু হয়।

উপসংহার : ডিরােজিও তাঁর অনুগামীদের মধ্যে স্বাধীন চিন্তার বীজ বপন করে যে আলােড়ন সৃষ্টি করেছিলেন তা প্রশংসার দাবি রাখে। মনেপ্রাণে ভারতপ্রেমী ডিরােজিও আমার স্বদেশের প্রতি’ (To India My Native Land) কবিতায় মাতৃভূমির বন্দনা করেছেন।

প্রশ্ন (২২) টীকা লেখাে : ইয়ং বেঙ্গল।

উত্তর:- ভূমিকা : হিন্দু কলেজের তরুণ অধ্যাপক হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরােজিওর প্রভাবে পাশ্চাত্যের যুক্তিবাদী ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলার তরুণ বুদ্ধিজীবীদের একাংশ যে উগ্র সংস্কারপন্থী আন্দোলন সৃষ্টি করেন তা ইয়ং বেঙ্গল বা নব্যবঙ্গ আন্দোলন নামে পরিচিত।

নব্যবঙ্গ দলের মূল উদ্দেশ্য : নব্যবঙ্গ দলের মূল উদ্দেশ্য ছিল—(১) জনসাধারণের মধ্যে যুক্তিবাদ প্রতিষ্ঠা ; (২) হিন্দুসমাজে প্রচলিত ধর্মীয় ও সামাজিক গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের বিরােধিতা করা এবং (৩) আধুনিক ও যুক্তিবাদী পাশ্চাত্য চিন্তাধারা ও শিক্ষার বিস্তার ঘটানাে।

নব্যবঙ্গ দলের কার্যকলাপ : ডিরােজিওর ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ ছাত্ররা (১) বিভিন্ন পত্রপত্রিকা, সভাসমিতি ও প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে প্রগতিশীল ধ্যানধারণা প্রচার করেন। ডিরােজিওর ছাত্রদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিলেন প্যারীচাঁদ মিত্র, রামতনু লাহিড়ি, দক্ষিণারঞ্জন মুখােপাধ্যায়, কৃয়মােহন বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ। (২) ইয়ং বেঙ্গলের সদস্যরা তাদের পত্রিকাগুলাের মাধ্যমে হিন্দুসমাজের বহুবিবাহ, নারীশিক্ষা, জুরির বিচার, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে লেখালেখি শুরু করেন ও তাদের সুচিন্তিত মতামত দেন।

সমালােচনা : সমাজের সাধারণ মানুষের সঙ্গে যােগসূত্র না-থাকায় সমাজজীবনে ইয়ং বেঙ্গল গােষ্ঠীর তেমন কোনাে প্রভাব পড়েনি। সবচেয়ে বড়াে কথা, দেশের সভ্যতা ও সংস্কৃতির দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে তারা পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণ করতে আগ্রহী ছিলেন। এই কারণে ঐতিহাসিক অমলেশ ত্রিপাঠী ইয়ং বেঙ্গল গােষ্ঠীকে ‘নকলনবীশের দল’ বলে মন্তব্য করেছেন।

উপসংহার : নানান সমালােচনা সত্ত্বেও ইয়ং বেঙ্গল অনুগামীদের সত্যানুসন্ধানী মনােভাব, দেশাত্মবােধ ও সংস্কৃতি চেতনা উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণকে সমৃদ্ধ করেছিল। 

প্রশ্ন (২৩) টীকা লেখাে : বিধবাবিবাহ আন্দোলন।

উত্তর:- ভূমিকা : উনিশ শতকে বাংলায় সমাজসংস্কারগুলির মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিল সতীদাহপ্রথা রদ ও বিধবাবিবাহ আন্দোলন প্রবর্তন।

বিধবাবিবাহ আন্দোলন : বিধবাবিবাহ আন্দোলন অষ্টাদশ শতক থেকেই গড়ে উঠেছিল এবং উনিশ শতকে বৃদ্ধি পেয়েছিল। এই আন্দোলনের বিভিন্ন দিক হল—

১. প্রগতিবাদীদের চেষ্টা : উনিশ শতকে নব্যবঙ্গ গােষ্ঠী বিধবাবিবাহের পক্ষে তাদের সুচিন্তিত মতামত প্রকাশ করেন এবং ১৮৩০-এর দশকে মতিলাল শীল, হলধর মল্লিক প্রমুখ সম্রান্ত ও প্রগতিশীল ব্যক্তির বিধবাবিবাহ প্রচলনে সচেষ্ট হন।

২. পত্রপত্রিকার চেষ্টা : উনিশ শতকে বিভিন্ন পত্রপত্রিকা (যেমন—সমাচার দর্পণ’, ‘জ্ঞানান্বেষণ’) ও সভাসমিতিতে (যেমন—বেথুন সােসাইটি) বিধবাবিবাহের পক্ষে প্রচার চালানাে হয়।

৩. বিদ্যাসাগরের চেষ্টা : ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিধবাবিবাহকে শাস্ত্রীয়’ বলে প্রমাণ করতে পরাশর সংহিতা’ থেকে উদ্ধৃতি তুলে ধরেন এবং এর পাশাপাশি তিনি বিধবাবিবাহ প্রবর্তন সংক্রান্ত আইন প্রণয়নের জন্য প্রায় এক হাজার জনের স্বাক্ষর করা আবেদনপত্র প্রেরণ করেন (অক্টোবর, ১৮৫৫ খ্রি.)। বিদ্যাসাগরের এই প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে রাজা রাধাকান্ত দেবের নেতৃত্বে তৎকালীন গোঁড়া হিন্দুরা একজোট হন।

৪. সরকারি উদ্যোগ : বিদ্যাসাগরের নেতৃত্বে বিধবাবিবাহের সপক্ষে আবেদনের পাশাপাশি বিধবাবিবাহের বিরুদ্ধেও অন্তত ১৪টি আবেদনপত্র সরকারের কাছে পাঠানাে হয়। শেষপর্যন্ত গভর্নর জেনারেল লর্ড ক্যানিং বিধবাবিবাহ আইন পাস করেন। (জুলাই, ১৮৫৬ খ্রি.)।

উপসংহার : বিধবাবিবাহ আইন পাস হলে বিদ্যাসাগর শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্নের সঙ্গে কালীমতীদেবী নামের এক বিধবার এবং নিজের পুত্র নারায়ণচন্দ্রের সঙ্গে আর-এক বিধবার বিবাহ দেন।

প্রশ্ন (২৪) বিধবাবিবাহ আন্দোলনে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান আলােচনা করাে।

উত্তর :- ভূমিকা : অষ্টাদশ শতক থেকেই বিধবাবিবাহ আন্দোলন গড়ে উঠেছিল এবং উনিশ শতকে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সুযােগ্য নেতৃত্বে এই আন্দোলন সফল হয়েছিল।

বিদ্যাসাগরের অবদান : বিদ্যাসাগর ছিলেন মানবতাবাদী, শিক্ষাব্রতী ও নারীমুক্তি আন্দোলনের পথিকৃৎ। তিনি বহুবিবাহের বিরােধিতার পাশাপাশি বিধবাদের বৈধব্য যন্ত্রণা উপলদ্ধি করে। এই আন্দোলনের সঙ্গে নিজেকে যেভাবে যুক্ত করেন তা হল - 

১. শাস্ত্র নির্ভরতা : বিধবাবিবাহে হিন্দুশাস্ত্রের সমর্থন খোঁজার জন্য তিনি ভারতের প্রাচীন পুথিপত্র ও গ্রন্থাদি পাঠ করেন ও বিধবাবিবাহের সপক্ষে লেখালেখি শুরু করেন এবং “পরাশর সংহিতা” থেকে উদ্ধৃতি তুলে প্রমাণ করেন যে বিধবাবিবাহ হিন্দুশাস্ত্র সম্মত।

২. গ্রন্থ প্রকাশ : বিদ্যাসাগর "বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব” (১৮৫৫ খ্রি.) নামক একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে বিধবাবিবাহের সপক্ষে জনমত গঠন করতে সচেষ্ট হন। বিদ্যাসাগরের মতামতের বিরুদ্ধে সেইসময় অন্তত ৩০টি প্রতিবাদ পুস্তক প্রকাশিত হয়।

৩. সরকারের কাছে আবেদনপত্র প্রেরণ : তিনি বিধবাবিবাহ প্রবর্তন সংক্রান্ত আইন প্রণয়নের জন্য প্রায় এক হাজার জনের স্বাক্ষর করা একটি আবেদনপত্র সরকারের কাছে প্রেরণ করেন। (অক্টোবর, ১৮৫৫ খ্রি.)। বিদ্যাসাগরের এই প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে রাজা রাধাকান্ত দেবের নেতৃত্বে তৎকালীন গোঁড়া হিন্দুরা একজোট হন। 

৪. সরকারি উদ্যোগ : বিদ্যাসাগরের নেতৃত্বে বিধবাবিবাহের সপক্ষে আবেদনের পাশাপাশি বিধবাবিবাহের বিরুদ্ধেও অন্তত ১৪টি আবেদনপত্র সরকারের কাছে পাঠানাে হয়। শেষপর্যন্ত গভর্নর জেনারেল লর্ড ক্যানিং বিধবাবিবাহ আইন পাস করেন। (জুলাই, ১৮৫৬ খ্রি.)।

উপসংহার : বিধবাবিবাহ আইন পাস হলে বিদ্যাসাগর শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্নের সঙ্গে কালীমতীদেবী নামের এক বিধবার এবং নিজের পুত্র নারায়ণচন্দ্রের সঙ্গে আর-এক বিধবার বিবাহ দেন। 

প্রশ্ন (২৫) সমাজসংস্কার আন্দোলনে হাজি মহম্মদ মহসিনের অবদান বিশ্লেষণ করাে।

উত্তর:-  ভূমিকা : অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ ও উনিশ শতকের গােড়ায় বাংলার মুসলিম সমাজে ও শিক্ষার ক্ষেত্রে একজন। উল্লেখযােগ্য মানবতাবাদী সমাজসেবক ও শিক্ষাব্রতী ছিলেন হাজি মহম্মদ মহসীন (১৭৩০/৩২-১৮১২ খ্রি.)।

পরিচিতি : মহম্মদ মহসীন হুগলি জেলার এক ধনী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এবং যৌবনকালে তিনি মক্কা-মদিনাসহ আরব দুনিয়ার বিভিন্ন তীর্থ স্থান ভ্রমণ করে হাজি’ উপাধি লাভ করে। দেশে প্রত্যাবর্তন করেন (১৭৯৪ খ্রিস্টাব্দ)।

অবদান : বৈমাত্রেয় দিদি মানু জানের মৃত্যুর পর হাজি মহম্মদ মহসীন হুগলি, যশাের ও মুরশিদাবাদে বিপুল সম্পত্তির অধিকারী হন। এরপর তিনি -

১. ট্রাস্টি গঠন : তিনি তাঁর উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত জমি ও সম্পদের ওপর ভিত্তি করে দানমূলক একটি ট্রাস্টি' বা সংস্থা গঠন করে।

২. সমাজসেবা : সমাজসেবামূলক কাজ ও শিক্ষার প্রসারে তিনি এবং তাঁর এই ‘ট্রাস্টি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

৩. শিক্ষা সংস্কার : তিনি সমাজের উন্নতির জন্য ধর্মীয় শিক্ষার পরিবর্তে আধুনিক শিক্ষার প্রসার ঘটাতে সচেষ্ট হন। তার তৈরি ট্রাস্টির অর্থ সহযােগিতায় পরবর্তীকালে হুগলি মহসীন কলেজ (১৮৩৬ খ্রি.) হুগলি কলেজিয়েট স্কুল, চট্টগ্রাম মহসীন কলেজ (১৮৭৪ খ্রি.) প্রতিষ্ঠিত হয়।

8. অন্যান্য অবদান : তার দানের অর্থের মাধ্যমে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের সহায়তার পাশাপাশি ক্ষুধার্ত, ভিক্ষুক, অসহায় বিধবা ও অনাথদেরও অর্থ সাহায্য করা হত।

উপসংহার : এভাবে হাজি মাহমুদ মহসী হয়ে উঠেছিলেন একাধারে মানবতাবাদী ও শিক্ষাদরদি। তার এই মহৎ অবদানের কথা স্মরণ করে স্যার আশুতােষ মুখোপাধ্যায় তাকে ‘আঠারো শতকের শ্রেষ্ঠ ভারতীয়দের অন্যতম’ বলে অভিহিত করেছেন। 

প্রশ্ন (২৬) ব্রাহ্মসমাজ আন্দোলনে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভূমিকা বিশ্লেষণ করাে।

উত্তর:- ভূমিকা : ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে রামমােহনের মৃত্যুর পর স্তিমিত ব্ৰায় আন্দোলনকে ১৮৪০-এর দশকে পুনরায় উজ্জীবিত করেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭-১৯০৫ খ্রি.)।

ব্রাহ্মসমাজের উন্নতি : দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৪২-৪৩ খ্রিস্টাব্দে ব্রাম্মসমাজে যােগদান করে ব্রাক্ষ্মসমাজের বিকাশের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন - 

১. তত্ত্ববােধিনী সভা গঠন : একেশ্বরবাদ ও বেদান্তের বাণী প্রচার এবং সংস্কারমুক্ত ধর্ম আলােচনা করার উদ্দেশ্যে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের নিয়ে তত্ত্ববোধিনী সভা (১৮৩৯ খ্রি.) গঠন করেন।

২. তত্ত্ববােধিনী পত্রিকা প্রকাশ : দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তত্ত্ববােধিনী সভার মুখপত্ররূপে ‘তত্ত্ববােধিনী পত্রিকা (১৮৪৩ খ্রি.) প্রকাশ করেন। সমকালীন সামাজিক কুসংস্কার ও গলদের বিরুদ্ধে মতামত প্রচার করা ছাড়াও খ্রিস্টান ধর্মের বিরুদ্ধেও এই পত্রিকা মুখর হয়েছিল।

৩. সংগঠন : দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রাহ্মসমাজের নিয়মাবলি, ধর্মাচার পদ্ধতি প্রবর্তন করে ব্রাহ্রসমাজকে একটি সাংগঠনিক রূপদানের মাধ্যমে এটিকে একটি পৃথক সংগঠনে পরিণত করেন।

৪. সমাজ উন্নয়ন : দরিদ্র হিন্দুদের খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হওয়ার প্রবণতাকে বন্ধ করতে দেবেন্দ্রনাথ কলকাতায় হিন্দু চ্যারিটেবল ইন্সটিটিউশন’ প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি হিন্দুধর্মের কুপ্রথার বিরুদ্ধে ও কৃষকদের উন্নতির জন্যও আন্দোলন সংগঠিত করেন।

উপসংহার : দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রাহ্বসমাজকে একটি স্বতন্ত্র সম্প্রদায়ে পরিণত করেন ও ব্রাত্যসমাজের আন্দোলন সুস্পষ্ট কাঠামাের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়।

প্রশ্ন (২৭) ব্রাহ্মসমাজ আন্দোলনে কেশবচন্দ্র সেনের ভূমিকা বিশ্লেষণ করাে। অথবা, কেশবচন্দ্র সেন ব্রাহ্মধর্মে কী পরিবর্তন ঘটান ?

উত্তর:- ভূমিকা : রামমােহন রায় প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্মসমাজ আন্দোলন ১৮৫০ ও ১৮৬০-এর দশকে কেশবচন্দ্র সেনের (১৮৩৮-১৮৮৪ খ্রি.) নেতৃত্বে গতিশীল হয়ে ওঠে।

পদক্ষেপ : কেশবচন্দ্র সেন ব্রাহ্সমাজ আন্দোলনকে দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করতে যে সমস্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করেন তা হল— 

১. কুসংস্কার-বিরােধিতা : অসাধারণ বাগ্মী ও সমাজসংস্কারক কেশবচন্দ্র সেন বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তােলেন।

২. ভারতীয় সংস্কার সভা গঠন : সমাজসংস্কার ও জনগণের নৈতিক উন্নতিসাধনের লক্ষ্যে সমাজসংস্কার আন্দোলনে গতি ও সংহতি আনতে কেশবচন্দ্র সেন ভারতীয় সংস্কার সভা গঠন করেন (১৮৭০ খ্রি.)।

৩. নববিধান প্রতিষ্ঠা :১৮৭০-এর দশকে কেশবচন্দ্র সেন ভক্তিবাদ ও গুরুবাদে আকৃষ্ট হওয়ায় এবং ব্রাত্মবিবাহ আইন অমান্য করে নিজের নাবালিকা কন্যার বিবাহ দেওয়ায় শিবনাথ শাস্ত্রী-কেন্দ্রিক ব্ৰাত্মগােষ্ঠীর সঙ্গে তার বিবাদ দেখা দিলে শেষপর্যন্ত কেশবচন্দ্র সেন নববিধান’ ব্রাহূসমাজ (১৮৮০ খ্রি.) প্রতিষ্ঠা করেন।

উপসংহার : কেশবচন্দ্র সেন তার সমাজসংস্কারের আদর্শের ভিত্তিতে ব্রাহ্র আন্দোলনকে বাংলা-সহ ভারতের বিভিন্ন স্থানে জনপ্রিয় করে তােলেন। আবার তার কারণেই ব্রাহ্রসমাজে ভাঙনের সৃষ্টি হয়।

প্রশ্ন (২৮) উনিশ শতকের বাংলায় সমাজসংস্কার আন্দোলনে ব্রাহ্মসমাজের ভূমিকার মূল্যায়ন করাে।

উত্তর:- ভূমিকা : উনিশ শতকের সমাজসংস্কার আন্দোলনে ব্রাম্মসমাজের উল্লেখযােগ্য ভূমিকা ছিল। এরমধ্যে উল্লেখযােগ্য হল— 

১. কুসংস্কারের বিরােধিতা ও যুক্তিবাদী চিন্তাধারার প্রসার :  ব্রাহ্মসমাজ ভারতীয় সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন কুসংস্কারের বিরােধিতা করে জনগণের মধ্যে যুক্তিবাদী চিন্তাধারার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।

২. জাতিভেদ ও ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরােধিতা : এই প্রতিষ্ঠানটি হিন্দু সমাজের জাতিভেদ প্রথা ও ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরােধিতা করে। হিন্দু ধর্মের নামে অধর্ম ও সামাজিক অত্যাচার প্রতিরােধে ব্রাত্যসমাজের উল্লেখযােগ্য অবদান ছিল।

৩. নারীকল্যাণের ভূমিকা : ভারতীয় নারীদের মধ্যে পর্দাপ্রথার বিলুপ্তিসাধন, বিধবাবিবাহের আইনসিদ্ধকরণ, বহুবিবাহ নিষিদ্ধকরণ, নারীসমাজের মধ্যে উচ্চশিক্ষার প্রচলন প্রভৃতি সমাজসংস্কারমূলক কাজকর্মে ব্রাত্যসমাজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে।

৪. জাতীয় সংহতির পথ রচনা : উদারপন্থী ধর্মীয় আদর্শ ও জাতীয়তাবাদের আদর্শ প্রচারের মাধ্যমে ব্রাত্যসমাজ জাতীয় সংহতির পথ রচনা করে।

৫. সমাজসেবা ও জনহিতকর কাজের আদর্শ প্রতিষ্ঠা : সমাজসেবা ও জনহিতকর কাজের মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী আদর্শের প্রতিষ্ঠা ছিল ব্রাহ্সমাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কেশবচন্দ্র সেনের নেতৃত্বে দুর্ভিক্ষ ও মহামারির সময় একদল বাঙালি তরুণকে নিয়ে ত্রাণের যে অনুকরণযােগ্য দৃষ্টান্ত ব্রাহ্বসমাজ রেখেছিল, তা পরবর্তীকালে রামকৃয় মিশন ও ভারত সেবাশ্রম সংঘের প্রধান আদর্শ হয়ে ওঠে।

প্রশ্ন (২৯) বিজয়কৃষ্ণ গােস্বামী ও ব্রাহ্ম আন্দোলন সম্পর্কে সংক্ষেপে আলােচনা করাে।

উত্তর:- ভূমিকা : উনিশ শতকে বাংলার ব্রাহ্ আন্দোলনের একজন বিখ্যাত নেতা ছিলেন বিজয়কৃয় গােস্বামী (১৮৪১-১৮৯৯ খ্রি.)। জন্মস্থান নদিয়ার শান্তিপুরের টোলে পড়া শেষ করে তিনি কলকাতার সংস্কৃত কলেজে ভর্তি হন। তিনি ব্রাত্য সমাজের আদর্শ ও দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ব্রাত্মধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করেন।

ব্রাহ্ম আন্দোলন : তিনি ব্রাহ্ম আন্দোলনে যেভাবে অংশ নেন  তা হল - 

১. ধর্ম প্রচারক : বিজয়কৃষ্ণ গােস্বামী (১৮৪১-১৮৯১খ্রি.) ছিলেন ব্রাহ্মধর্মের একজন বিখ্যাত প্রচারক।

২. পূর্ববঙ্গে ধর্ম প্রচার : তিনি কেশবচন্দ্র সেনের সঙ্গে কলকাতার বাইরে পূর্ববঙ্গে ব্রাত্মধর্ম প্রচারের পাশাপাশি ব্রাহ্ উপাসনা মন্দির, বালিকা বিদ্যালয়, দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপনের ব্যবস্থা করেন। 

৩. নব্য বৈষ্ণববাদের প্রবর্তক : তিনি পরবর্তীকালে নব্য বৈয়ববাদের প্রবর্তন করেন ও রাধাকৃয়ের মূর্তিপূজার অভিযােগে সাধারণ ব্রাত্যসমাজ কর্তৃক তিনি অভিযুক্ত হন। শেষপর্যন্ত তিনি ব্রাহ্সমাজ ছেড়ে বেরিয়ে আসেন ও শেষ ১৪ বছর তিনি বৈষ্ণবধর্ম প্রচার করেন।

৪. শিষ্যবর্গ : বিজয়কৃয় গােস্বামীর সঙ্গে স্বামী বিবেকানন্দের সুসম্পর্ক ছিল। বিজয়কৃষ্ণ গােস্বামীর উল্লেখযােগ্য শিষ্য ছিলেন বিপিনচন্দ্র পাল, অশ্বিনীকুমার দত্ত, সতীশচন্দ্র মুখার্জী প্রমুখ।

প্রশ্ন (৩০) বাংলার সমাজজীবনে লালন ফকিরের অবদান কী ?

উত্তর:- ভূমিকা : উনিশ শতকে বাংলার সমাজজীবন ও ধর্মীয় জীবনের ক্ষেত্রে সমন্বয়সাধনকারী একজন উল্লেখযােগ্য ব্যক্তি ছিলেন লালন ফকির বা লালন সাঁই (১৭৭৪-১৮৯০ খ্রি.)।

পরিচিতি : নদিয়ার পূর্বতন পাবনা জেলার কুমারখালি অথবা ঘােড়াই-কুষ্টিয়াতে লালন ফকির জন্মগ্রহণ করেন এবং তরুণ বয়সে তীর্থ ভ্রমণে বের হয়ে ঘটনা পরম্পরায় সন্ন্যাস গ্রহণ করেন।

সমাজজীবনে অবদান : লালন ফকির তৎকালীন সমাজজীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, যেমন—

১. বাউলের জনপ্রিয়করণ : লালন ফকির সিরাজ সাঁই নামক বাউলগুরুর কাছে দীক্ষা গ্রহণ করেন ও বাউল সাধনা করে তিনি বাউল গীতিকে জনপ্রিয় করে তােলেন।

২. জাতিভেদ প্রথার বিরােধিতা : লালন ফকির জাতিভেদ প্রথার তীব্র বিরােধিতা করেন এবং উচ্চবর্ণের মানুষের দাম্ভিকতা ও কর্তৃত্ববাদের বিরােধিতা করেন।

৩. মানবধর্মের প্রচার : লালনের ধর্ম বিশ্বাস সম্পর্কে মতপার্থক্য রয়েছে, কারণ কেউ তাকে হিন্দু, কেউ তাকে মুসলিম বলে মনে করেন। হিন্দু-মুসলিম সবধর্মের মানুষের সঙ্গে তার সু-সম্পর্ক ছিল। এবং তিনি আল্লা-মহম্মদ-কৃয়-গৌর সবাইকে নিয়ে বাঁধা বাউলের মাধ্যমে মানবধর্মের কথা প্রচার করেন।

উপসংহার : লালন ফকির বিশ্বাস করতেন সকল মানুষের মাঝে বাস করে এক ‘মনের মানুষ। এই মানুষের জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও লিঙ্গভেদ নেই। এভাবে তিনি মনের মানুষ’-এর কথা ও জাতপাতহীন সমাজের কথা প্রচার করে যথার্থভাবেই হয়ে উঠেছিলেন মানবধর্মের একজন জ্বলন্ত প্রতীক।

প্রশ্ন (৩১) শ্রীরামকৃষ্ণদেবের সমন্বয়বাদী মতাদর্শ বিশ্লেষণ করাে।

উত্তর :- ভূমিকা : উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে শ্রীরামকৃয়দেবের (১৮৩৬-১৮৮৬ খ্রি.) সমন্বয়বাদী মতাদর্শ ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। দক্ষিণেশ্বরে রানি রাসমণি প্রতিষ্ঠিত কালী মন্দিরের পুরােহিত গদাধর চট্টোপাধ্যায় বিভিন্ন ধর্মসাধনার মাধ্যমে শ্রীরামকৃষ্ণদেব-এ পরিণত হন।

সমন্বয়বাদী মতাদর্শ : শ্রীরামকৃষ্ণ যেভাবে সমন্বয়বাদী মতাদর্শ প্রতিষ্ঠা করেন তা হল -

১. ধর্মভাবনা : রামকৃষ্ণদেব সব ধরনের ধর্মীয় বিভেদ ও বিদ্বেষ ঘুচিয়ে প্রচার করেন যে, সাকার, নিরাকার একই ঈশ্বরের বিভিন্ন রূপ। প্রত্যেকেই নিজ নিজ মত ও পথ অনুসরণ করে ঈশ্বর সাধনায় নিয়ােজিত হতে পারে।

২. মানবতাবাদ : ধর্ম নয় মানুষের মনুষ্যত্বই তার কাছে গুরুত্ব লাভ করে; তাই তার কাছে তার ধর্মমতের একটি বিশেষ দিক হল মানবতাবােধ। তার কাছে জীবসেবা ও মানবসেবা ছিল ঈশ্বরসেবার প্রকারভেদ মাত্র।

৩. আধ্যাত্মিক শান্তি : উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে শিক্ষিত যুবকদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে বেকারত্বও বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে বাঙালি যুব সম্প্রদায়ের মনে বেকারজনিত হতাশা বৃদ্ধি পেলে তিনি আধ্যাত্মিক শান্তির পথনির্দেশ করেন।

৪. জাতিভেদ প্রথার বিরােধিতা : শ্রীরামকৃষ্ণের মতে, প্রত্যেক মানুষই হল শক্তির আধার; তাই তিনি প্রত্যেক মানুষকে সমান মর্যাদাদানের কথা প্রচারের মাধ্যমে সমাজে জাতিভেদ প্রথা ও অস্পৃশ্যতা অনেকটা হ্রাস পায়।

উপসংহার : শ্রীরামকৃষ্ণের এই সমন্বয়বাদী মতাদর্শ একদিকে যেমন বিভিন্ন ধর্মের মানুষদের মধ্যে সংহতিদান করেছিল তেমনি তা ক্ষয়িষ্ণু হিন্দুধর্মে প্রাণসঞ্চারও করেছিল।

প্রশ্ন (৩২) স্বার্মী বিবেকানন্দের ধর্মসংস্কারের আদর্শ ব্যাখ্যা করো। 
অথবা, স্বামী বিবেকানন্দের ‘নব্য বেদান্ত’ আদর্শ ও তার প্রয়ােগ ব্যাখ্যা করাে। 
অথবা, ধর্ম ও সমাজসংস্কার আন্দোলনে স্বামী বিবেকানন্দের চিন্তাধারা সংক্ষেপে উল্লেখ করাে।

উত্তর:- ভূমিকা : অদ্বৈতবাদে বিশ্বাসী স্বামী বিবেকানন্দের মতে, মানব সেবাই ধর্মের সর্বোচ্চ লক্ষ্য এবং একারণেই তিনি আত্মমুক্তি অপেক্ষা সমাজের উন্নতির ওপর অধিক গুরুত্ব দেন। তিনি বনের বেদান্ত’কে ঘরে আনার কথা বলেন এবং বেদান্তকে মানব কল্যাণের কাজে ব্যবহারের কথা বলেন যা নব্য বেদান্ত’ নামে পরিচিত। 

চিন্তাধারা : তার চিন্তাধারা বিভিন্ন দিকে যেভাবে বাস্তবায়িত হয়েছিল তা হল - 

১. গঠনমূলক সমালােচনা : প্রকাশ্য রাজনীতিতে না নামলেও বিভিন্ন রচনার মাধ্যমে বিবেকানন্দ তৎকালীন ভারতের দারিদ্র্য, অস্পৃশ্যতা, অশিক্ষা, কুসংস্কার, জাতিভেদ, নারীনির্যাতন, ধর্মীয় বিরােধ প্রভৃতির বিরুদ্ধে তীব্র কশাঘাত হেনেছিলেন।

২. দরিদ্রদের সেবা : ভারতবর্ষের পথে-প্রান্তরে ভ্রমণ করে বিবেকানন্দ দরিদ্র ও অজ্ঞ ভারতবাসীর মধ্যে ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। জীবের মধ্যেই তিনি ভগবান শিবকে প্রত্যক্ষ করে বলেছিলেন—যত্র জীব তত্র শিব।

৩. সমাজমুক্তি : মানবতাবাদী ও সমাজপ্রেমী বিবেকানন্দ আত্মমুক্তি অপেক্ষা সমাজের উন্নতির জন্য বেদান্তকে মানবহিতের কাজে ব্যবহারের কথা প্রচার করেন। এভাবেই ‘নব্যবেদান্ত’ তার ধর্মসংস্কারের অভিমুখের মূল ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়।

৪. রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠা : জাতির মধ্যে ত্রাণকার্য, শিক্ষার প্রসার, সুচিকিৎসার প্রসার এবং প্রকৃত মানুষ গড়ার উদ্দেশ্যে ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দের ৫ মে তার উদ্যোগে রামকৃয় মিশন প্রতিষ্ঠিত হয়।

      স্বামী বিবেকানন্দের নব্যবেদান্ত ছিল সমকালীন সময়ের একটি প্রয়োজনীয় ধর্মাদর্শ। কুসংস্কার আর নানান নিয়মের যাঁতাকলে পড়ে যখন হিন্দুধর্মের মানুষের নাভিশ্বাস উঠছে, তখন মানবপ্রেমের সনাতনী আদর্শের সমন্বয়ে গড়ে তোলা বিবেকানন্দের নব্য বেদান্তবাদই মুক্তির স্বাদ জুগিয়ে ছিল। 

৫. শিকাগো সম্মেলন  :- স্বামী বিবেকানন্দ ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকার শিকাগো বিশ্বধর্ম সম্মেলনে যোগ দেন। সেখানে তিনি তাঁর বক্তৃতায় ভারতের সনাতন হিন্দুধর্মের অদ্বৈত্ব বেদান্তের বিশ্বজনীন আদর্শ ও বিশ্বজনীন মানবপ্রেমের আদর্শ। 

প্রশ্ন (৩৩) প্রাচ্যবিদ্যাচর্চা বলতে কী বোঝায় ? 

উত্তর :- ভূমিকা : ভারতে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠার পর ভারতীয় শিক্ষার ক্ষেত্রে সংস্কৃত, আরবি ও ফারসি ভাষার মাধ্যমে দেশজ শিক্ষার উন্নতির জন্য যে নীতি গৃহীত হয়েছিল তা প্রাচ্যবিদ্যাচর্চার নীতি নামে পরিচিত। বাংলার গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস ছিলেন প্রাচ্যবিদ্যাচর্চার প্রধান পৃষ্ঠপােষক।

প্রাচ্যবিদ্যাচর্চা : মূলত এদেশের রীতিনীতি, আইনকানুন দ্বারা এদেশকে শাসনের প্রয়ােজনীয়তা দেখা দেয় এবং এই প্রয়ােজন থেকেই - 

১. কলকাতা মাদ্রাসা : আরবি ও ফারসি ভাষা শিক্ষার উন্নতি ও মুসলিম আইনচর্চার উদ্দেশ্যে ওয়ারেন হেস্টিংস ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন কলকাতা মাদ্রাসা।

২. বেনারস সংস্কৃত কলেজ : হিন্দু আইন ও দর্শন এবং সংস্কৃত ভাষার উন্নতির জন্য জোনাথান ডানকান বেনারসে প্রতিষ্ঠা করেন বেনারস সংস্কৃত কলেজ।

৩. এশিয়াটিক সােসাইটি : প্রাচ্যবিদ্যাচর্চার জন্য হেস্টিংসের পৃষ্ঠপােষকতায় স্যার উইলিয়াম জোনস প্রতিষ্ঠা করেন এশিয়াটিক সােসাইটি (১৭৮৭ খ্রি.) নামক প্রাচ্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান। এখানের বিশিষ্ট প্রাচ্যবিদ্যাবিশারদছিলেন উইলিয়াম উইলকিন্স, ন্যাথানিয়েল হ্যালহেড, হােরেস হেম্যান উইলসন প্রমুখ।

৪. ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ : গভর্নর জেনারেল লর্ড ওয়েলেসলি ভারতীয় সিভিল সার্ভেন্টদের মানসিক গঠন ভারতীয় ভাষা ও রীতিনীতিতে গড়ে তােলার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠা করেন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ। এখানে পাশ্চাত্য শিক্ষার পাশাপাশি প্রাচ্যবিদ্যা শিক্ষাও প্রদান করা হত।

উপসংহার : প্রাচ্যবিদ্যাচর্চার ফলে– (১) ভারতীয় ভাষা, সংস্কৃতি ও রীতিনীতির চর্চার মাধ্যমে হিন্দু ও মুসলিম সভ্যতার গৌরবময় ঐতিহ্য পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়; (২) প্রাচ্যবিদ্যার প্রসারকে কেন্দ্র করে পরবর্তীকালে প্রাচ্য-পাশ্চাত্য বিতর্ক গড়ে ওঠে।

প্রশ্ন (৩৪) বাংলার নবজাগরণ ও তার প্রকৃতি আলােচনা করাে।

উত্তর :- ভূমিকা : উনিশ শতকের গােড়ায় বাংলার শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধর্ম, সমাজ প্রভৃতি ক্ষেত্রে—এক নবচেতনার সূচনা হয় যা বাংলার নবজাগরণ’ নামে পরিচিত। এই নবজাগরণ ছিল প্রাচ্যবাদ ও পাশ্চাত্যবাদী আদর্শের সংমিশ্রণ। 

নবজাগরণের কয়েকটি দিক : বাংলার নবজাগরণের কয়েকটি
বিশিষ্ট দিক হল—

১. অনুসন্ধানী মানসিকতা : পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রভাবে বাঙালিরা অনেকে রক্ষণশীলতা বর্জন করে যুক্তিবাদী হয়ে ওঠায় ধর্ম ও সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্র যুক্তিবাদের দ্বারা মূল্যায়িত হতে থাকে। 

২. সমাজ ও ধর্মসংস্কার : বাংলার ধর্ম ও সমাজের কুসংস্কারগুলি দূর করে আধুনিক করে তােলার প্রক্রিয়া শুরু হয়। হিন্দুধর্মের মধ্য থেকেই হিন্দুধর্মের সংস্কারসাধন যেমন ছিল নবজাগরণের একটি দিক, তেমনি আবার সরকারি সাহায্যে সতীদাহপ্রথা রদ ও বিধবাবিবাহ প্রবর্তন সমাজসংস্কারের বিখ্যাত উদাহরণ। 

৩. গৌরবময় অতীত পুনরুদ্ধার : প্রাচ্যবাদ চর্চার নীতি এবং ধর্ম ও সমাজ সংস্কারের মাধ্যমে ভারতের অতীত গৌরব পুনরুদ্ধারের জন্য সমাজ ও ধর্মসংস্কারের প্রয়ােজনে যুক্তিবাদের পাশাপাশি শাস্ত্রীয় প্রমাণ অনুসন্ধান প্রচেষ্টা থেকে সংস্কৃত সাহিত্যের চর্চা শুরু হয়।

৪. স্বতন্ত্র নবজাগরণ : বাংলার নবজাগরণ ইটালির নবজাগরণের সঙ্গে তুলনীয় নয়, বরং বাংলার নবজাগরণের সামাজিক ভিত্তি ছিল উদীয়মান শিক্ষিত, বুদ্ধিজীবী ও মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়। 

উপসংহার : বাংলার নবজাগরণ মূলত ছিল কলকাতা শহরকেন্দ্রিক, তাই তা সামগ্রিকভাবে সমস্ত বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে নি। তবে এই নবজাগরণের মাধ্যমে বাংলার ধর্ম ও সমাজে আধুনিকতার সঞ্চার হয়েছিল।


**************** সমাপ্ত ******************

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ