Type Here to Get Search Results !

বিজ্ঞান ও কুসংস্কার প্রবন্ধ রচনা Science and Superstition

 বিজ্ঞান ও কুসংস্কার প্রবন্ধ রচনা Science and Superstition  

বিজ্ঞান ও কুসংস্কার 

ভূমিকা ঃ বিজ্ঞান কথার অর্থ হল বিশেষ জ্ঞান। এই বিশেষ জ্ঞানের আলোকে মানুষ সাধারণ প্রাণী থেকে শ্রেষ্ঠ প্রাণীতে পরিণত হয়েছে। সেই আদিম কাল থেকেই বিবর্তনের মধ্য দিয়ে মানুষ জগত ও জীবনকে ক্রমশ বেশি বেশি করে জানতে, বুঝতে ও চিনতে শিখেছে। আদিম মানুষ ছিল গুহাবাসী কিন্তু বর্তমানে বিজ্ঞানের বলে বলীয়ান হয়ে মানুষ অট্টালিকা নির্মাণ করেছে। যেসব প্রাকৃতিক শক্তিকে দেখে সে ভয় পেত সেগুলিকে বশীভূত করে নিজের দাসে পরিণত করেছে। বর্তমান যুগ প্রকৃত অর্থেই বিজ্ঞানের যুগ। মানুষের বুদ্ধির বিকাশ ঘটেছে দিন দিন। সে জানতে পেরেছে যে এই পার্থিব জগতের কোনো কিছুই অলৌকিক ভাবে ঘটেনা। প্রত্যেক ঘটনার পেছনেই থাকে তার যুক্তিনির্ভর কারণ। কিন্তু এই কাতণগুলি বোঝার মত মেধা ও মানসিকতা সব মানুষের হয়না। মানুষ তার বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়ে বিশ্বের অনেক নিগূঢ় সত্যের দ্বার খুলে দিয়েছে। একদিকে যেমন হয়েছে জ্ঞানের অগ্রগতি তেমনই অন্য দিকে লক্ষ লক্ষ মানুষের চেতনায় থেকে গিয়েছে অজ্ঞানতার অন্ধকার। সূচনা হয়েছে বিজ্ঞান চেতনার সাথে কুসংস্কারের সংঘাত। 

কুসংস্কার কী ? 

আক্ষরিক অর্থে কুসংস্কার কথার অর্থ হল , 'কু (খারাপ) যে সংস্কার।' অন্যভাবে বললে, যেসব সংস্কার যুক্তিহীন এবং মানুষের পক্ষে অহিতকর, সেগুলিকে কুসংস্কার বলে। প্রাচীনকালে মানুষ কিছু বিশ্বাস বা ধারণার বশবর্তী হয়ে বিভিন্ন কার্যকলাপ করত। এগুলিই সংস্কার। যেমন - প্রাচীন ভারতে অতিথি-অভ্যাগতদের দেখে নমস্কার করা হত। এইরকম অনেক ভালো সংস্কার এখনও প্রচলইত আছে। সব সংস্কার কুসংস্কার নয়, যেগুলি যুক্তিহীন কেবল সেগুলিকেই কুসংস্কার বলা হয়। যেমন - যাত্রাকালে হাঁচিকে অশুভ মনে করা একটা কুসংস্কার। 

বিজ্ঞানের উদ্ভব ঃ মানুষ জগতের শ্রেষ্ঠ জীব। শারীরিক দক্ষতার দিক থেকে তার চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী প্রাণী থাকলেও তার বুদ্ধির কাছে সকলেই পরাজিত। মানুষ তার বুদ্ধিবৃত্তি ও নিরন্তর অনুশীলনের মাধ্যমে জগত ও জীবনের নানান রহস্যের সমাধান সূত্র জানতে পেরেছে। বিজ্ঞানীরা আমাদের জানিয়েছেন এই বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের সৃষ্টি রহস্যের কথা। জানিয়েছেন পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন বিজ্ঞান ও জীব বিজ্ঞানের কথা। প্রকৃতির নানান উপাদানকে কাজে লাগিয়ে মানুষ সৃষ্টি করেছে অসীম শক্তি। বিজ্ঞানের এই সূত্র ধরেই এগিয়ে এসেছে প্রযুক্তি বিজ্ঞানের যুগ। ব্যাবহারিক ও জ্ঞানগত উভয় দিক থেকে মানুষের জীবনের সাথে বিজ্ঞানের ঘনিষ্ঠতা ক্রমশই বেড়েছে। মানুষের জীবন যাত্রায় এসেছে অসংখ্য পরিবর্তন । বিজ্ঞান বুদ্ধি মানুষকে দিয়েছে এক দুর্লভ শক্তির খোঁজ। 

কুসংস্কারের উৎপত্তি ঃ আদিম মানুষ পাহাড়ে-জঙ্গলে বাস করত তখন বিজ্ঞানের জন্ম হয়নি। মানুষ সেই সময় অতিপ্রাকৃত সত্তাই বিশ্বাসী ছিল। যে-কোনো প্রাকৃতিক ক্রিয়াকান্ডের কারণ ও উৎস সম্পর্কে কোন ধারণা না থাকায় এসবের মূলে অপদেবতারা ক্রিয়াশীল। সেকালের মানুষের মনে দৃঢ়বদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। ভুত-প্রেত প্রভৃতি অশরীরী আত্মার কারসাজি রয়েছে বলে নিরক্ষর বিজ্ঞানচেতনাহীন মানুষ বিশ্বাস করত। এভাবেই কুসংস্কারের উদ্ভব ও প্রসার ঘটে। 

কুসংস্কারের স্বরূপ ঃ কুসংস্কার ধর্মকে আশ্রয় করে বিকশিত হয়েছে, যেমন - গঙ্গাসাগরে সন্তান বিসর্জন , বলিদান প্রথা, দেবতাদের স্বপ্নাদেশ, মানুষের মধ্যে দেবদেবীর ভর করা, বিশিষ্ট গাছকে বৃক্ষ দেবতা জ্ঞানে পূজা করা, ভন্ড সাধু সন্ন্যাসীর প্রতিবিশ্বাস বা গ্রহ রত্ন ধারণ, জ্যোতির্বিদ্যায় আস্থা, এছাড়াও নানান কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস মানুষের চেতনায়স্তরকে প্রভাবিত করেছে। আবার ধর্মীয়প্রভাব মুক্ত কুসংস্কার রয়েছে, যেমন - জোড়া শালিক দেখা, যাত্রাকালে পিছু ডাকা, বিড়ালের রাস্তা দিয়ে আড়াআড়িভাবে যাওয়া কিংবা এক চক্ষু দর্শনে অমঙ্গল ইত্যাদি কুসংস্কারও মানব জীবনকে প্রভাবিত করে। তাই বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন কুসংস্কারের উৎস সম্পর্কে বলেন - "It is this undefined source of fear and hope which is the genesis irrational Superstition." 

ফলাফল ঃ কুসংস্কারের ফলে ব্যাক্তিগত জীবনে ও পারিবারিক জীবনে অনেক ক্ষতি স্বীকার করতে হয় ফলে ভন্ড সাধু সন্ন্যাসী, জ্যোতিষী, ওঝা, তান্ত্রিকদের দ্বারা মানুষ নিত্য প্রবঞ্চিত হচ্ছে। রোগ নিরাময়ের জন্য তুকতাক, জলপড়া পুজো-আচ্ছা, ওঝা-বৈদ্য ইত্যাদিতে নির্ভর করে রোগীর মৃত্যু ঘটে যায়। 

বিজ্ঞান বনাম কুসংস্কার ঃ বিজ্ঞান এবং কুসংস্কার একে অপরের বিপরীত প্রান্তে অবস্থিত। বিজ্ঞান যুক্তিকে প্রাধান্য দেয় কিন্তু কুসংস্কার যুক্তির ধার ধারে না। তাই যেখানে বিজ্ঞান থাকে সেখানে কুসংস্কার থাকতে পারে না। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, একই মানুষের মনে বিজ্ঞান এবং কুসংস্কার পরস্পর সহাবস্থান করে। হাসপাতালগামী অ্যাম্বুলেন্সও অনেক সময় রাস্তায় বিড়াল পারাপার করতে দেখলে ব্রেক কষে। আরও আশ্চর্য লাগে যখন দেখি কিছু মানুষ মোবাইল ফোনের মাধ্যমে কুসংস্কার প্রচার করে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে একদল অসাধু মানুষ কুসংস্কারকে জিইয়ে রাখতে চায়। 

কুসংস্কার দূরীকরণে বিজ্ঞান ঃ অন্ধকার দূর করতে যেমন আলোর প্রয়োজন হয়, তেমনি কুসংস্কারকে নির্মূল করতে পারে এক এবং একমাত্র বিজ্ঞান। বিজ্ঞানকে বইয়ের পাতায় বন্দি না রেখে মানুষের মধ্যে বিজ্ঞানচেতনার উন্মেষ ঘটাতে হবে। তবেই কজুসংস্কারের গতিরোধ করা সম্ভব হবে। সরকারিভাবে এমন কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে যাতে জনমানসে বৈজ্ঞানিক ধ্যানধারণার প্রসার ঘটে। বিজ্ঞান মঞ্চগুলি এ ব্যাপারে সদর্থক ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে। সংবাদপত্র, বেতার, দূরদর্শন এবং ইন্টারনেটের মাধ্যমেও কুসংস্কার-বিরোধী প্রচার চালানো যেতে পারে। তাছাড়া, বিদ্যালয় পাঠ্যসূচিতে এমন পাঠ অন্তর্ভুক্ত করতে হবে যাতে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মও কুসংস্কারমুক্ত হতে পারে। 

বিজ্ঞানের জয়যাত্রা ঃ মানুষ যেদিন আগুন জ্বালাতে শিখলো সেদিনই পরোক্ষ তাদের অজান্তে বিজ্ঞানের জন্ম হলো। মানুষ নানারকম ধাতুর ব্যবহার শিখলো। মানুষ প্রয়োজনে তাগিদে বিভিন্ন রকম জিনিস তৈরি করতে লাগলো, শুরু হলো গবেষণাগারে পরীক্ষা-নিরীক্ষা। বিজ্ঞানের দৌলতে আবিষ্কার হলো নানারকমের ঔষধ। দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞানের অবদান একে একে স্থান করে নিল। 

শিক্ষা ও সচেতনতা প্রসারে বিজ্ঞান ঃ কুসংস্কার তথা অন্ধবিশ্বাস দূরীকরণে বিজ্ঞান সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে অবদান রাখে সেটি হল শিক্ষা ও সচেতনতা ব্যাপক ও সার্বিক প্রসার। সর্বজনীন শিক্ষা এবং সচেতনতার প্রচার ছাড়া সমাজ থেকে সার্বিকভাবে কুসংস্কার অন্ধবিশ্বাস দূরীকরণ সম্ভব নয়। বর্তমানে বিজ্ঞানের আধুনিক সমস্ত আবিষ্কার এবং বৈজ্ঞানিক মননের ফলে সমাজের সর্বস্তরে শিক্ষা এবং সচেতনতা ব্যাপক প্রচার-প্রসার সম্ভব হচ্ছে। শিক্ষা ও সচেতনতা সেই প্রসারের উপর ভিত্তি করে একটু একটু করে সকল স্তরে গড়ে উঠেছে। বিজ্ঞানমনস্ক । ফলে যুক্তির কষ্টিপাথরের মাধ্যমে যাচাই হচ্ছে সত্য, দূরীভূত হচ্ছে অন্ধবিশ্বাস। ফলে অন্ধ বিশ্বাস ও তার শিকড় হারিয়ে অচিরেই বিনষ্ট হয়ে যাবে। 

উপসংহার ঃ বিজ্ঞান হল মানুষের আপন সভ্যতাকে দেওয়া উতকৃষ্টতম উপহার। এই উতকৃষ্টতম উপহারের সাহায্যে সমাজ শুধুমাত্র ভোগবিলাসগত দিক থেকেই সাবালক হয়ে ওঠেনি, বরং ধীরে ধীরে মানসিক ভাবেও সচেতন হয়ে উঠেছে। তাই সমাজ থেকে কুসংস্কারকে সম্পূর্ণরূপে দূরীভূত করার প্রয়োজনে একান্ত প্রয়োজন বৈজ্ঞানিক মননের ব্যাপক বিকাশ। সেই বিকাশমূলক গঠন প্রক্রিয়া ছাড়া অন্ধবিশ্বাসের আয়নাতে আত্মরূপ দর্শন সম্ভব নয়। আর আত্মরূপ দর্শন না হলে কুসংস্কারের সার্থক দূরীকরণ কতখানি সম্ভব হবে, সে বিষয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ